ভুট্টোর ‘দুই পার্টি সমাধানে’ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যাপক ক্ষোভ

১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ ছিল সোমবার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে পূর্ব পাকিস্তানে লাগাতার অসহযোগ আন্দোলনের অষ্টম দিন। এই দিনটিও  শান্তিপূর্ণ সভা-শোভাযাত্রা ও সরকারি, আধা-সরকারি অফিস-আদালত বর্জনের মাধ্যমে অতিবাহিত হয়। ৭ মার্চের পর উত্তাল পরিস্থিতিতে শাসক ইয়াহিয়া এদিন ঢাকায় আসেন। প্রচলিত রীতি ভেঙে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের কোনও ব্যবস্থা ছিল না। তার সফরসূচিতেও ছিল গোপনীয়তা।

ইয়াহিয়া বাংলাদেশে আসার আগে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন দাবি উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, ‘দেশে আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির সমন্বয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে।’ করাচিতে এক জনসভায় কয়েকজন প্রখ্যাত রাজনীতিক বলেন, ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ থেকে অনেক কথাই বলেছেন। কিন্তু তিনি ভুলে গেছেন তার পিপলস পার্টি এই অঞ্চলে শতকরা ৩৮ ভাগ ভোটও পায়নি। তারা বলেন, ক্ষমতা গ্রহণের জন্য আওয়ামী লীগই একমাত্র দল। পরের দিনের ইত্তেফাকের সংবাদে বলা হয়—এদিন বঙ্গবন্ধু নতুন নির্দেশ দেন। ভুট্টোর ‘দুই পার্টি সমাধানে’ পশ্চিম পাকিস্তানেই ব্যাপক ক্ষোভ দেখা যায়। সর্বমহলে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। ভুট্টোর সমাধানকে অগণতান্ত্রিক বলে উল্লেখ করেন পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা।

১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলা পত্রিকায় একাত্তরের মার্চের ধারাবাহিক বর্ণনা প্রকাশ করা হতো। সেখানে পত্রিকায় বলা হয়, অসহযোগ আন্দোলন এই দিনে এসে প্রতিরোধের মাত্রা আরও  ছড়িয়ে পড়েছে। এ সময়ে দেশ পরিচালিত হতো বঙ্গবন্ধুর দেওয়া নির্দেশনার ওপর। মাঝে মাঝে তাজউদ্দীন আহমদ ব্যাখ্যা দিতেন নির্দেশাবলির। পাকিস্তানের সামরিক আইন জনতার বলিষ্ঠ সংগ্রামের মুখে পড়েছিল। দেশের মানুষ সেসময় সবকিছু একেবারেই অচল করে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ছাড়া আর সবকিছুই তারা উপেক্ষা করতো। এই দিনে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষায় অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান বাঙালিদের প্রতি।

একইসঙ্গে সেই সময়টায় সাংস্কৃতিক আন্দোলন জোরদার হচ্ছিল রোজ। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে সব কাজে বাংলা প্রচলনের সিদ্ধান্ত হয়। স্থানীয় শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের এক সভায় চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্রের গণবিরোধী ভূমিকার নিন্দা করা হয়। বেতার কেন্দ্রে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়।

এদিনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বেতার ও টিভিশিল্পীরা দেশাত্মবোধক গান করেন। দেশবাসী বেশি উৎসাহ ও উদ্দীপনা পেয়ে নিজেদের সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করতে থাকে। এদিন ঢাকা শহরে শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক সবার সভা-সমাবেশ চলতেই থাকে। শিল্পাচার্য জয়নুলের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন এবং অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী তাদের রাষ্ট্রীয় খেতাব বর্জন করেন। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এ খেতাব বর্জনের বিষয়টি ব্যাপক সাড়া ফেলে।

পেশাজীবীরাও আন্দোলন জোরদার করছিল। এদিন চিকিৎসকরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত সভা থেকে অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং মুক্তি আন্দোলনের লক্ষ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামে প্রস্তুত হওয়ার জন্য জনতার প্রতি আহ্বান জানান।

এর আগে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আয়োজনে নতুন সামরিক ফরমান জারির প্রতিবাদে ১৪ মার্চ বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে সভা হয়। সেখানে বাংলাদেশ রক্ষায় সব নাগরিককে অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানানো হয়। সভা শেষে বিক্ষুব্ধ জনতার মিছিল ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে।

সংগ্রাম পরিষদের মিছিলটি কাকরাইল, বেইলি রোড হয়ে প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে দিয়ে অতিক্রম করে। ইয়াহিয়া খান তখন ওই ভবনেই অবস্থান করছিলেন। ভবনের সামনে সামরিক বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য উপস্থিতি ছিল। পরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে মিছিলটি শেষ হয়।