বাখমুতে গোলাবারুদ পোড়াচ্ছে ইউক্রেন, ঝুঁকিতে পাল্টা আক্রমণ?

পূর্বাঞ্চলীয় বাখমুত শহরের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে প্রতিদিন হাজারো কামানের গোলা ছুড়ছে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী। মার্কিন ও ইউরোপীয় কর্মকর্তারা বলছেন, এই হারে যদি ইউক্রেন গোলাবারুদ ব্যবহার করতে থাকে তাহলে তাদের পরিকল্পিত পাল্টা আক্রমণ জটিলতায় পড়তে পারে। তাদের আশা, এই পাল্টা আক্রমণ যুদ্ধের জয়-পরাজয় নির্ধারক হবে।

দুই মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ইউক্রেনের কামান বর্ষণ এত বেড়েছে যে সম্প্রতি কিয়েভের কাছে এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছে মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগন। বিশেষ কয়েক দিন ধরে অবিরাম কামানের গোলা বর্ষণের পর এই উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

যেকোনও মূল্যে বাখমুতের পতন ঠেকানো নিয়ে ইউক্রেনের সিদ্ধান্ত নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের উত্তেজনার ইঙ্গিতও এতে পাওয়া যাচ্ছে। দুই মার্কিন কর্মকর্তার একজন বলেছেন, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গোলাবারুদ অপচয় না করতে ইউক্রেনকে সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

ইউক্রেন আসন্ন পাল্টা আক্রমণকে গুরুত্ব দেওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন প্রস্তুতি নিচ্ছে লাখো রাউন্ড কামানের গোলা ও রকেট ইউক্রেনকে সরবরাহ করার জন্য। এর মধ্যে থাকবে ন্যাটো মানের ও সোভিয়েত আমলের কামানের গোলা।

কিন্তু এক সিনিয়র মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা এটিকে ‘শেষ প্রচেষ্টা’ হিসেবে দেখছেন। কারণ ইউক্রেন যে গতিতে গোলাবারুদ ব্যবহার করছে সেই গতিতে তা উৎপাদনের সক্ষমতা নেই মিত্রদের। একই সঙ্গে মিত্রদের মজুতও ঝুঁকিপূর্ণ মাত্রায় কমে গেছে। পশ্চিমা অস্ত্র নির্মাতারা উৎপাদন বাড়াচ্ছে। কিন্তু চাহিদা পূরণের জন্য নতুন সরবরাহ পেতে কয়েক মাস লেগে যাবে।

এটি ইউক্রেনকে একটি ক্রমবর্ধমান বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ফেলে দিচ্ছে: পাল্টা আক্রমণে যাওয়ার একটি অর্থপূর্ণ সুযোগ পাচ্ছে ইউক্রেনীয় সেনারা, তারা রুশ সেনাদের তাড়িয়ে দখলকৃত সব ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারের সুযোগ। তাদের হয়ত এই পাল্টা আক্রমণ চালাতে হবে গোলাবারুদের ঘাটতির মধ্যেই।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনিশ্চয়তা। একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর হতাহতের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। এতে করে কমান্ডারদের সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে বাখমুত রক্ষায় আরও সেনা মোতায়েন করা হবে, নাকি তাদের পাল্টা আক্রমণের জন্য ব্যবহার করা হবে। এসব কর্মকর্তার বেশিরভাগ কথা বলেছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে। কারণ এসব বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলার এখতিয়ার তাদের নেই।

ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধে কামান গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হাউইটজার ও মর্টার। উভয়পক্ষের শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকার কারণে লড়াই মূলত হচ্ছে ভূমিতে। যুদ্ধ যখন দ্বিতীয় বছরে গড়িয়েছে তখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে কার কাছে বেশি বা পর্যাপ্ত গোলাবারুদ ও সেনা রয়েছে।

যুদ্ধের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দুই লক্ষাধিক রুশ সেনারা আহত বা নিহত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইউক্রেনের হতাহতের সংখ্যা ১ লাখের বেশি হতে পারে। রাশিয়া নিজেদের বিপুল জনগণের মধ্য থেকে নতুন সেনা সমাবেশ করতে পারবে। ইউক্রেনের চেয়ে দেশটির জনসংখ্যা তিনগুণ বেশি। তবে গোলাবারুদ ঘাটতিতে রয়েছে উভয় দেশ। রুশ সেনারা ইউক্রেনীয়দের বেশি গোলাবর্ষণ করছে।

সম্প্রতি বাখমুতে লড়াইরত এক ইউক্রেনীয় সেনা বলেছেন, আমাদের মর্টারের শেল প্রয়োজন। তার ব্যাটালিয়নকে পুনরায় গোলাবারুদ পাঠানো হয়নি। এক ইউক্রেনীয় ট্যাংক কমান্ডার বলেছেন, তার ট্যাংকের গোলাবারুদ প্রায় নেই বললেই চলে।

অপর এক ব্রিগেডের কমান্ডার ফেসবুকে মঙ্গলবার ‘কামানের গোলার বিপর্যয়কর ঘাটতির’ কথা লিখেছেণ। তিনি একটি ঘটনার কথা লিখেছেন, যাতে রাশিয়ার একটি টি-৯০ ট্যাংককে তার ইউনিট অচল করতে সক্ষম হয়। কিন্তু সেটিকে একেবারে ধ্বংস করার জন্য গোলাবর্ষণ করতে দেওয়া হয়নি। কারণ এটি খুব ব্যয়বহুল।

পেন্টাগনের ধারণা মতে, বাখমুতসহ ৬০০ মাইল দীর্ঘ ফ্রন্ট লাইনে প্রতিদিন কয়েক হাজার কামানের গোলাবষর্ণ ছুড়ছে ইউক্রেন। রুশ সেনারা বাখমুত প্রায় ঘিরে ফেলেছে। অর্ধেক শহর রুশ বাহিনীর দখলে এবং ইউক্রেনের একমাত্র সাপ্লাই লাইনে তারা আক্রমণ করে যাচ্ছে। শহরটিতে লড়াইয়ে টিকে থাকতে এই সাপ্লাই লাইন ইউক্রেনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

যুক্তরাষ্ট্র আশা করছে, প্রতি মাসে ৯০ হাজার কামানের গোলা উৎপাদন করতে পারবে। কিন্তু এই সক্ষমতা অর্জনে সময় লাগবে দুই বছর। ইউরোপীয় ইউনিয়নও উৎপাদন বাড়াচ্ছে এবং ১০ লাখের মতো গোলা কিনছে। এতেও সময় লাগবে। ব্রিটেনের একটি গোপন টাস্ক ফোর্স বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে সোভিয়েত আমলের গোলাবারুদ কিনতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ইউক্রেন এমন অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। ইউক্রেনের রয়েছে পশ্চিমাদের সরবরাহকৃত ৩৫০টি হাউইটজার। কিন্তু বেশিরভাগ কামান সোভিয়েত আমলের।

লিথুয়ানিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী বুধবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ইউক্রেনকে আমাদের আরও সহযোগিতা করতে হবে, তাদের আরও অস্ত্র দিতে হবে। সোভিয়েত আমলের অস্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে তিনি সন্দেহ পোষণ করে বলেছেন, সবচেয়ে ভালো সমাধান হলো ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রের উৎপাদন বাড়ানোর সম্ভাব্যতা খুঁজে দেখা।

আর এই কাজটিই সহজ নয় বিশ্বের অত্যাধুনিক সামরিক শক্তির দেশগুলোর জন্য। যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির মিত্ররা কামান যুদ্ধের কথা বিবেচনায় নিয়ে নিজেদের অস্ত্রের মজুত গড়ে তুলেনি। ইউক্রেনে পাঠানো কয়েকশ’ ট্যাংক ও সাঁজোয়ান দেশটির সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করবে নিশ্চিত, কিন্তু যদি পর্যাপ্ত কামানের গোলা না থাকে তাহলে এগুলোর কার্যকারিতা হবে সীমিত।

আপাতত, বাইডেন প্রশাসন এখনও আত্মবিশ্বাসী যে, বাখমুতে নিজেদের গোলাবারুদ শেষ করে ফেলবে না ইউক্রেন। এত সেনা হারাবে না কিয়েভ যাতে করে পাল্টা আক্রমণ ঝুঁকিতে পড়ে। কিন্তু লড়াই যত দীর্ঘ হবে, প্রশাসনের এই আত্মবিশ্বাসে পরিবর্তন আসতে পারে।

বাখমুতে গোলাবারুদ পোড়াচ্ছে ইউক্রেন, ঝুঁকিতে পাল্টা আক্রমণ?

হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি মঙ্গলবার বলেছেন, ইউক্রেনও সেনা হারাচ্ছে। তাদের অবমাননা করার অর্থে আমি এমনটি বলছি না। কিন্তু রাশিয়া যে পরিমাণে সেনা হারাচ্ছে সেই তুলনায় ইউক্রেনের হতাহত কম।

অবশ্য শুধু সংখ্যাতেই বাখমুতের পরিস্থিতি উঠে আসছে। এটি চলমান যুদ্ধের সবচেয়ে রক্তাক্ত লড়াই। ক্রেমলিনের ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপ কারাগার থেকে নিয়োগ দেওয়া যোদ্ধাদের সম্মুখ সমরে পাঠাচ্ছে। এর অর্থ হলো স্বল্প প্রশিক্ষিত রাশিয়ার পদাতিক সেনাদের সঙ্গে লড়াইয়ে ইউক্রেন তাদের যুদ্ধে পরীক্ষিত সেনা হারাচ্ছে।

বাখমুত একটি ছোট শহর। কিন্তু এই শহরের সড়ক আরও পূর্ব দিকে যাওয়ার সুযোগ করে দেবে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের জন্য প্রতীকী অর্থে গুরুত্বপূর্ণ। বাইডেন প্রশাসন বাখমুতের লড়াই অবসানের কোনও সময়সীমা বেঁধে দেয়নি। তারা বলছে, পিছু হটা বা লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কেবল ইউক্রেনের। 

ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স-এর প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ ক্যামিল গ্রান্ড বলছেন, ইউক্রেন যে নিজের ভূখণ্ড রক্ষা করবে, এজন্য বাখমুত তাদের কাছে রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এটির স্বার্থকতা প্রমাণ করতে হবে। বাখমুত ধরে রাখার কৌশলগত কারণ নেই তা বলা যাচ্ছে না। এর ফলে রাশিয়া সরঞ্জাম ও সেনা হারাতে পারে। এটি ধরে রাখতে আরও পশ্চিম দিকে তারা যেতে পারবে না।

তিনি বলেন, এত রক্তপাত ও গোলাবারুদ হারানোর যুক্তি হতে পারে এটি। বিকল্প যা ঘটতে পারে, দীর্ঘমেয়াদে পরিস্থিতি রাশিয়ার অনুকূলে যেতে যাবে, সেখান থেকে তাদের ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হতে পারে।

নিউ ইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে।