বঙ্গবন্ধু তখন ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছিলেন, ৩২ নম্বরে নামতো মানুষের ঢল

১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতার খবরে ১৮ তারিখের নানা বিষয় উঠে আসে। সেদিনের প্রধান খবরের শিরোনাম করা হয়, ‘এ গণবিস্ফোরণ মেশিনগানেও স্তব্ধ করা যাইবে না’। পাশে ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তর্জনী ওঠানো একটি স্থিরচিত্র। তার ওপরে ‘আমি শেখ মুজিব বলছি’ উল্লেখ করা ছিল। এদিনের দৈনিক ইত্তেফাকের প্রধান খবরে জানানো হয়— ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন এখন মুক্তিকামী জনতার তীর্থক্ষেত্র। স্বাধীনতাকামী বাংলার মানুষের অসহযোগ আন্দোলনের ধারাক্রমে আবাল-বৃদ্ধ বনিতা নির্বিশেষে সমাজের সব পর্যায়ের মানুষের যেন ঢল নেমেছে।

সারাদিন ধরে আনাগোনাকারী বিদেশি সাংবাদিকদের দৃষ্টি এসব মিছিলের দিকে। একপর্যায়ে আবেগভরা কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বিদেশি বন্ধুরা, দেখুন। ভোর ৫টা থেকে রাত পর্যন্ত আপনারা শুধু এই দৃশ্যই দেখতে পাবেন। আমার দেশের মানুষ আজ  প্রতিজ্ঞায় কী অটল, সংগ্রাম আর ত্যাগের মন্ত্রে কত উজ্জীবিত, কার সাধ্য তাদের রোখে?’

শেখ মুজিবের কথায়, ‘আমার দেশ আজ জেগেছে, জনগণ জেগেছে, জীবন দিতে শিখেছে। স্বাধীনতার জন্য জীবনদানের অগ্নিশপথে দীপ্ত জাগ্রত জনতার এ জীবন জোয়ারকে, প্রচণ্ড এ গণবিস্ফোরণকে স্তব্ধ করতে পারে এমন শক্তি মেশিনগানেরও আজ  নাই।’

স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু  সেদিনও ঘরে ঘরে সংগ্রামের দুর্গ গড়ে তোলার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘বাংলার মানুষ, তোমরা ঘরে ঘরে সংগ্রামের দুর্গ গড়ে তোলো। আঘাত যদি আসে প্রতিহত করো, পাল্টা আঘাত হানো। ৭ কোটি শোষিত-বঞ্চিত বাঙালির সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। চরম ত্যাগের বিনিময়ে হলেও আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাবোই। দরকার হলে রক্ত দিয়েই আমরা দাবি প্রতিষ্ঠা করবো। তবু শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না।’

জাতীয় জীবনের সেই সংকট-সন্ধিক্ষণে রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া ও জাতীয় নেতা শেখ মুজিবের মধ্যে দুই-দফা বৈঠকের পর তৃতীয় বৈঠকের কোনও সময় ধার্য না হওয়ায় গণমনে নানা প্রশ্নের জন্ম হয়। ছাত্র, যুবক, নার্স, ব্যাংককর্মী, নার্সিং স্কুল ও কলেজের ছাত্রী, ট্রাকচালকসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের সংগ্রামী মানুষের মিছিল এসে নেতার প্রতি অকুণ্ঠ আস্থা জ্ঞাপন করে এবং প্রতিদানে তাঁর আশীর্বাদ কামনা করে।

তবে দিনব্যাপী জনতার মিছিলের পর রাতে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়, পরদিন বেলা ১১টায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে রাজনৈতিক সংকট নিয়ে তৃতীয় দফা আলোচনা হবে।

সেনাবাহিনীর সদস্যরা তেজগাঁও ও মহাখালীতে শ্রমিকদের ট্রাকে হামলা চালায়। সৈন্যরা এই দুই স্থানে নিরস্ত্র আরোহীদের নির্মমভাবে প্রহার করে এবং তাদের টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়। এসব ঘটনায় নগরীতে জনসাধারণের মধ্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। রাতে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংবাদপত্রে বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, ‘আমরা পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই, নিরস্ত্র মানুষের ওপর উসকানিমূলক আচরণ, তা যে কোনও মহলেরই হোক না কেন, আমরা আর সহ্য করবো না। এর ফলাফলের দায়িত্ব উসকানিদাতাদেরই সম্পূর্ণ বহন করতে হবে।’

১৮ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক লে. জেনারেল টিক্কা খানের  গঠিত তদন্ত কমিটি ও কমিটি গঠনের ব্যাপারটি প্রত্যাখ্যান করে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। পরের দিন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় প্রকাশিত সেই বিবৃতির অংশবিশেষ ছিল এরকম— ‘এ ধরনের কমিশন দিয়ে কোনও ফায়দা পাওয়া যাবে না। এ ধরনের তদন্ত আদৌ কোনও প্রকৃত তদন্ত হবে না, সত্যেও উপনীত হওয়া যাবে না। বরং এটা হবে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপকৌশল মাত্র।’

১৮ মার্চ বঙ্গবন্ধু প্রতারণামূলক কমিশন প্রত্যাখ্যান করে তদন্তের জন্য নতুন কমিশন গঠন করেন। এদিন পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি ওয়ালী খান ঢাকায় আসেন। তিনি সমস্যা সমাধানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে এক ঘণ্টা বৈঠক করেন। সে সময় তার সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের ন্যাপ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এদিন করাচিতে বসে ভুট্টো স্পষ্ট জানিয়ে দেন, আলোচনার জন্য তিনি ঢাকা গেলেও কোনও কাজ হবে না।  ঢাকা আসতে তার অসম্মতি রাজনৈতিক জটিলতা বৃদ্ধি করে। এদিন পাকিস্তানের করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা মিয়া মমতাজ দৌলতানা জানান, তার দল কেন্দ্রে ও প্রদেশে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে রাজি আছে। তিনি বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা মেনে নেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন।

এরমধ্যেই চলছে নানা দলের প্রতিবাদী বিবৃতি। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক বিবৃতিতে স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে বিশ্ব নেতৃত্বের সমর্থন কামনা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও চীন প্রভৃতি দেশের সরবরাহকৃত অস্ত্র দিয়ে বাঙালি নিধনের প্রয়াস বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর কাছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত সামরিক বাহিনী ও অস্ত্রের চালান বোঝাই উড়োজাহাজের চলাচল বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়।

এদিন আরও কিছু ঘটনা একের পর এক ঘটতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি বিভিন্ন দেশের সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুদ্ধিজীবীদের কাছে তারবার্তা পাঠিয়ে— গণহত্যা ও যুদ্ধ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানকে নিবৃত্ত করার অনুরোধ জানায়। বাংলাদেশের জন্য খাদ্যশস্যবাহী ‘ইরনা এলিজাবেথ’ নামের একটি জাহাজের গতিপথ বদল করে চট্টগ্রাম থেকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকায় বিমান বাহিনীর সাবেক বাঙালি সৈনিকরা স্বাধীনতার সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন।