পিছিয়ে পড়া থিয়েটারকর্মীদের দ্বিগুণ তালে কাজের প্রত্যয়

থিয়েটারকে বলা হয় অভিনয়শিল্পের সূতিকাগার। সিনেমা-নাটক সৃষ্টির আগে থিয়েটারই ছিল দর্শকদের অভিনয়সুধা পান করার একমাত্র কেন্দ্র। তাই বিশ্বজুড়ে সংস্কৃতির প্রায় সকল মাধ্যমে থিয়েটারের প্রভাব এখনও বহমান। বিশ্ব অনেক দূর, দেশের অভিনয়শিল্পের দিকে নজর দিলেও অনুভব করা যাবে থিয়েটারের প্রভাব। চলমান বাংলাদেশের বিকশিত চলচ্চিত্র, নাটক ও সংস্কৃতির বিকাশে এখনও অধিকার নিয়ে কাজ করছেন মঞ্চ থেকে উঠে আসা অধিকাংশ মুখ।

তবে সময়ের বিবর্তনে কিংবা সঠিক সংগঠকের অভাবে অথবা আকাশ সংস্কৃতির চাপে ক্রমশ ম্লান হচ্ছে দেশের থিয়েটার বা মঞ্চনাটক। এর ভেতর এসেছে মহামারির গ্রাস। রয়েছে সাংগঠনিক দুর্বলতা। সব মিলিয়ে থিয়েটার কর্মীরা খুব বেশি স্বস্তিতে নেই এখন। তেমনই কিছু অস্বস্তি মাথায় নিয়ে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সোমবার (২৭ মার্চ) পালিত হচ্ছে বিশ্ব থিয়েটার দিবস। যদিও দিবসটিকে বাংলাদেশে পালন করা হয় বিশ্ব নাট্য দিবস হিসেবে।

বিশ্বের নাট্যকর্মী ও শিল্পীদের মধ্যে সৌহার্দ্য স্থাপন ও নাটকের শক্তিকে নতুন করে আবিষ্কার করার লক্ষ্যে প্রতি বছর ২৭ মার্চ এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন সূত্রে জানা যায়, ১৯৮২ সাল থেকে দেশে বিশেষ মর্যাদায় এই দিনটি উদযাপিত হয়ে আসছে। ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট (বাংলাদেশ কেন্দ্র), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ সম্মিলিতভাবে দিবসটি উদযাপন করে। এবার আয়োজনটি হচ্ছে রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায়। এতে অংশ নেবেন দেশের নাট্যজনরা। থাকছে সেমিনার-পথসভাসহ নানান আয়োজন।

লাকী ইনাম

এবারের দিবসটিতে নাট্যকর্মীদের প্রত্যাশা বা প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে দেশের অন্যতম নাট্যদল নাগরিক নাট্যাঙ্গনের প্রধান লাকী ইনাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিশ্ব থিয়েটার দিবস হলেও আমরা এটাকে বিশ্ব নাট্য দিবস হিসেবে পালন করি। আমার প্রত্যাশা বা বক্তব্যটি এমন, আমরা বেশ পিছিয়ে গিয়েছিলাম করোনায়। এখন আমাদের দ্বিগুণ পরিশ্রম নিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের এগিয়ে যাওয়ার কোনও বিকল্প নেই। সবাইকে মিলেই, সব দলের সব সদস্যরা মিলে কাজের গতি বাড়াতে হবে। এরমধ্যে আমাদের নাগরিক নাট্যাঙ্গনও কাজ শুরু করে দিয়েছে। সিনসিয়ারলি আমাদের মঞ্চকে আরও এগিয়ে নিতে হবে। এটাই আমার প্রত্যাশা ও অঙ্গীকার।’

মামুনুর রশীদ

এদিকে দিনকে লক্ষ্য করে কিংবদন্তি অভিনেতা-নির্মাতা-মঞ্চনাটকের দিকপাল আরণ্যক নাট্যদলের প্রধান মামুনুর রশীদের কণ্ঠে মিলেছে হতাশা। কথায় কথায় তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বললেন, ‘আমাদের থিয়েটার এখন অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। আমাদের নাট্যসংস্কৃতি নষ্ট হয়ে গেছে। সেদিকে আমাদের আবার মনোযোগ দিতে হবে। আমরা যদি মঞ্চটাকে আরও উজ্জ্বল করতে না পারি, দর্শকদের ভালো মানের নাটক দিয়ে না টানতে পারি, তাহলে যেটুকু আছে সেটিও ভেস্তে যাবে। এজন্য আমাদের আরও তৎপর হওয়া দরকার। এই দিনে সেই তৎপরতাই আশা করি সবার মধ্যে।’

এই নাট্যজন বিশ্ব নাট্য দিবসকে খুবই দরকারি বলে মনে করেন। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা মনে করে বলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমরা হারিয়েছি অনেক নাট্যকর্মী। সেটা ছিল গোটা বিশ্বের নাট্যজনের জন্য কষ্টের বিষয়। পরে সেটা বিশেষ দিন হলো। সারা বিশ্বে এটা পালন হয় এখন। এমন দিনে বিশ্বজুড়ে নানান আয়োজনের মাধ্যমে থিয়েটারের যেসব চ্যালেঞ্জ, সেটাকে সামনে আনার চেষ্টা করি। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিবস আমাদের জন্য।’

মাসুম রেজা

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত নাট্যকার ও দেশ নাটকের অন্যতম নির্দেশক নাট্যজন মাসুম রেজা এই দিবসটিকে দেখেছেন বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই দিবসটি আমাদের প্রতি বছর স্মরণ করিয়ে দেয়, আসলে এই নাটক বা থিয়েটার সারা বিশ্বকে সংযুক্ত করে। এটা নির্দিষ্ট কোনও দেশ বা অঞ্চলের মধ্যে আটকে নেই। থিয়েটারের ভাষা যে বিশ্বজুড়ে এক– সেটারও প্রমাণ মেলে। সেটা যে ভাষার নাটকই হোক। আমি বলতে চাইছি, থিয়েটারের ভাষাটাই বৈশ্বিক। সেজন্যই গোটা বিশ্বের থিয়েটারের মানুষগুলো এই দিনটিতে নতুন করে কথা বলে, ভাবে ও ভাবায়। আমি মনে করি, এই ভাবনাতেই বিশ্ব নাট্য দিবসের ভাবার্থ প্রকাশ পায়।’

কিন্তু এবারের দিবসটিতে একজন নাট্যকর্মী হিসেবে মাসুম রেজার প্রত্যাশা বা প্রতিশ্রুতি কী? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নাট্যকর্মী হিসেবে মনে করি– থিয়েটারের যে আন্তর্জাতিকতা আছে, সেটা স্মরণে রেখেই কাজ করতে হবে। সবাই যদি মাথায় সেই বৈশ্বিক বিষয়টি নিয়ে কাজ করি, তবেই আমাদের উন্নয়ন হবে। সেটাই আমার প্রতিশ্রুতি ও প্রত্যাশা।’

ইতিহাস সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬১ সালের জুন মাসে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) নবম কংগ্রেসে বিশ্ব থিয়েটার দিবস প্রবর্তনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। পরের বছর প্যারিসে অনুষ্ঠেয় (১৯৬২ সালে) থিয়েটার অব নেশন্স উৎসবের সূচনার দিনটি অর্থাৎ ২৭ মার্চ প্রতি বছর বিশ্ব নাট্য দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

দিবসটি পালনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্বের সব দেশের নাট্যকর্মীদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন, সম্প্রীতি, উদ্দীপনা সৃষ্টি এবং এর মাধ্যমে নাটকের উন্নয়ন সাধন। বিভিন্ন দেশে বিদ্যমান ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) স্থানীয় কেন্দ্রগুলো প্রধানত এই দিবস পালনে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে।