উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় মার্কিন সম্পৃক্ততার প্রত্যাশা ঢাকার

মার্কিন নেতৃত্বের সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। আগামী ১০ এপ্রিল ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্থনি ব্লিনকেনের সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে মোমেনের। এক বছর পর দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠক হচ্ছে। এই বৈঠকে উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় মার্কিন সম্পৃক্ততা প্রত্যাশা করে ঢাকা। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র চায় মূল্যবোধভিত্তিক সম্পর্ক।

এর আগে গত বছরের ৪ এপ্রিল ওই বৈঠকের পর কয়েকবার দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় দেখা হলেও আনুষ্ঠানিক বৈঠক হচ্ছে এবার।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে একাধিক বিষয়ে দুই মন্ত্রীর মধ্যে আলোচনা হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক বলেন, ‘বিশ্বব্যবস্থায় নতুন মেরুকরণ হচ্ছে এবং প্রভাব বলয়ে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে, যা গোটা আলোচনার আবহে থাকবে। এই বৈঠকটি এমন সময় হচ্ছে, যখন রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে একটি মতবাদভিত্তিক দ্বন্দ্ব ক্রমেই প্রকাশ পাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনার প্রেক্ষাপটে সেটি প্রতীয়মান হবে। কিন্তু আলোচনায় যেটি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে সেটি হচ্ছে, দুই দেশের জাতীয় স্বার্থ ও বর্তমান প্রেক্ষাপট।’

শহীদুল হক আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় যুক্তরাষ্ট্র সব সময় আমাদের পাশে থেকেছে। কিন্তু আমরা যেভাবে চাই, সেভাবে অনেক সময় হয়নি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পৃথিবীর অনেক দেশ আমাদের শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা দিলেও মার্কিন বাজারে ওই সুবিধা দেওয়া হয়নি।’

মূল্যবোধভিত্তিক সম্পর্কের বিষয়ে সাবেক সচিব বলেন, ‘মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন। ওই প্রেক্ষাপটে তারা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক তৈরি করতে চায়। অনেক সময় এটি সম্ভব হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে হয় না। কিন্তু একটি চেষ্টা সব সময় থাকে।’

বাংলাদেশ এখন আগের যেকোনও সময়ের থেকে তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী এবং বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে আরও দৃঢ়ভাবে সম্পৃক্ত। সে জন্য ওই বৈঠকের ইতিবাচক ফলাফলের বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব আশা ব্যক্ত করেন।

দুই মন্ত্রীর বৈঠকের গুরুত্ব
বিভিন্ন কারণে আব্দুল মোমেন ও এন্থনি ব্লিনকেনের এবারের বৈঠকটি অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রলম্বিত হচ্ছে, যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ক্ষতি করছে। যুদ্ধ বন্ধে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বাংলাদেশের একটি অবস্থান আছে। ২০২৬ সালের পর স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পর উন্নয়ন অগ্রযাত্রা মসৃণ রাখার জন্য ধারাবাহিক বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন এবং এ ক্ষেত্রে মার্কিনিদের সহযোগিতা চায় বাংলাদেশের। বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য বাজার-সুবিধা নিয়েও আলোচনা করতে চায় বাংলাদেশ।

অন্যদিকে বাংলাদেশে এটি নির্বাচনের বছর এবং এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট অবস্থান রয়েছে। এ ছাড়া বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি, বাকস্বাধীনতা, সুশীল সমাজের কাজ করার জায়গা, আইনের শাসন নিয়ে সাম্প্রতিক মানবাধিকার রিপোর্টে তাদের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে।

দুপক্ষের প্রস্তুতি
এ ধরনের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে কোন বিষয়গুলো আলোচনা হবে, সেটি আগে থেকে ঠিক করা থাকে এবং সেই অনুযায়ী উভয় পক্ষ প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসে।

ঢাকা ও ওয়াশিংটন উচ্চপর্যায়ের বৈঠক সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ঢাকার দিক থেকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার, রোহিঙ্গা, রাশেদ চৌধুরীর প্রত্যাবাসন, বহুপক্ষীয় সহযোগিতাসহ অন্য বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়। অন্যদিকে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র, রোহিঙ্গা, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মার্কিন অবস্থানকে সমর্থন দেওয়ার আহ্বানসহ অন্য বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয় যুক্তরাষ্ট্র।’

এই কর্মকর্তা বলেন, ‘মার্কিনিদের আগ্রহের জায়গার বিষয়ে বৈঠকের আগে সরকার বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে অবস্থান তৈরি করে এবং সেটির ওপর ভিত্তি করে আলোচনা হয়। তবে আলোচনায় স্পর্শকাতর বিষয় অত্যন্ত কৌশলের সঙ্গে এবং সাবধানতার সঙ্গে শব্দচয়ন ব্যবহার করতে হয়।’

কূটনীতিতে বিভিন্ন অপ্রীতিকর বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হয় এবং সেগুলোর যত ভালো প্রস্তুতি থাকে, তত ভালো সন্তোষজনক সমাধান করা সম্ভব হয় বলে তিনি জানান।

মার্কিন সম্পৃক্ততা
গত ১৬ মার্চ রাইসিনা ডায়ালগে বাংলাদেশ ও ভারত সম্পর্ক নিয়ে এক অনুষ্ঠানে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পঙ্কজ শরণ বলেন, পশ্চিমা বিশ্ব কখনোই বাংলাদেশের ওপর খুশি ছিল না। ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্র তাদের মতো করে বাংলাদেশকে বিশ্লেষণ করে। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্বের ধারণা পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সঠিক যোগাযোগও করা হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক বলেন, ‘আগের যেকোনও সময়ের থেকে বাংলাদেশ এখন অনেক বেশি বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখে। বাংলাদেশের নিজস্ব আন্তর্জাতিক স্বার্থ এবং এখানে অন্য দেশের স্বার্থ এখন অনেক বেশি।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিটি বৈঠকই বাংলাদেশের জন্য একটি সুযোগ মার্কিন দৃষ্ঠিভঙ্গিকে পরিবর্তন করার জন্য। আমরা যত বেশি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবো, কাজটি করা আমাদের জন্য তত বেশি সহজ হবে।’