হাইকোর্টে আটকে আছে আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানি

বহুল আলোচিত রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে হরকাতুল জিহাদের (হুজি) বোমা হামলার ঘটনায় বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানি হাইকোর্ট বিভাগে আটকে আছে। আদালতের বিচারপতিদের পরিবর্তন ও রাষ্ট্রপক্ষের সময় আবেদনের কারণেই দীর্ঘদিন ধরে শুনানি হচ্ছে না মামলাটির।

মামলার বিবরণী থেকে জানা গেছে, ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান চলাকালে নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকাতুল জিহাদের (হুজি) জঙ্গিদের বোমা হামলায় ১০ জন নিহত ও অনেকে আহত হন।

এ ঘটনায় থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি মামলা হয়। পরে ২০০৮ সালের ২৯ নভেম্বর হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে সিআইডি হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করে। পরে দীর্ঘ শুনানি নিয়ে হত্যা মামলাটি বিচারিক আদালতে শেষ হয়।

২০১৪ সালের ২৩ জুন বহুল আলোচিত রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক রুহুল আমিন। রায়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকাতুল জিহাদের (হুজি) শীর্ষ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, বিএনপি নেতা ও সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনসহ ৮ জনের ফাঁসি ও ৬ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়। অনাদায়ে আরও এক বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত।এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন আসামিরা।

মুফতি হান্নান ছাড়াও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্যরা হলেন—মাওলানা তাজউদ্দিন, মওলানা আকবর হোসেন, মুফতি আব্দুল হাই, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মওলানা আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মুফতি শফিকুর রহমান ও মাওলানা আরিফ হাসান সুমন। এর মধ্যে মুফতি আবদুল হান্নানের পৃথক একটি মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন—হাফেজ মওলানা আবু তাহের, মওলানা সাব্বির ওরফে আব্দুল হান্নান সাব্বির, হাফেজ মওলানা ইয়াহিয়া, মওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, মওলানা আব্দুর রউফ ও শাহাদত উল্লাহ ওরফে জুয়েল।

হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের পর একই বছর নিয়ম অনুসারে মামলাটি (আপিল ও ডেথ রেফারেন্স) হাইকোর্টে আসে। এরপর প্রস্তুত করতে দেওয়া হয় মামলার পেপারবুক। পরে বিভিন্ন সময়ে আট আসামির ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আপিল হাইকোর্টের কয়েকটি বেঞ্চের কার্যতালিকায় উঠেছিল। কিন্তু সব প্রস্তুতি শেষ হলেও মামলাটির শুনানি শুরু করা সম্ভব হয়নি।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, মামলাটি হাইকোর্টে আসার পর যেসব বেঞ্চ শুনানির জন্য দায়িত্ব পেয়েছিল, সেসব বেঞ্চের কয়েকজন বিচারপতি বিভিন্ন সময়ে আপিল বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ফলে মামলাটি শুনানির জন্য বেঞ্চ বদল হতে থাকে। ২০১৭ সালের ৮ জানুয়ারি বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে তৎকালীন হাইকোর্ট বেঞ্চে মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি শুরু হয়। এরপর একই বছরের ১৪ মার্চ চূড়ান্ত যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের জন্য দিন ঠিক করা হয়। পরে আদালত মামলাটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেন। এরপর মামলাটি যায় বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি এ এসএম আব্দুল মোবিনের হাইকোর্ট বেঞ্চে। সেখানে দীর্ঘদিন থাকার পরও মামলাটি শুনানি না হয়ে পরবর্তী বেঞ্চে আসে। এরই মাঝে নেমে আসে করোনা ভাইরাসের হানা। ২০২১ সালের ২৪ জুন মামলাটি শুনানির জন্য বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ ও বিচারপতি এ এস এম আব্দুল মোবিনের নেতৃত্বাধীন ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চে কার্যতালিকায় আসে। তবে শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ সময় আবেদন করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন হাইকোর্ট। আর এভাবেই শুনানির অপেক্ষায় বছর বছর ঝুলে আছে মামলার শুনানি।

এ বিষয়ে আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, মামলাটি শুনানির জন্য হাইকোর্টের তিনটি বেঞ্চে কার্যতালিকায় উঠলেও শুনানি শেষ হয়নি। মামলাটি সর্বশেষ যে বেঞ্চটিতে ছিল সে কোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি আপিল বিভাগে নিয়োগ পেয়েছেন।  এখন প্রধান বিচারপতি নতুন কোনও বেঞ্চ নির্ধারণ করে দিলে তবেই মামলাটির শুনানি শুরু হবে। আমরা শুনানির জন্য প্রস্তুত রয়েছি।

অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় থেকে জানা গেছে, তারা মামলাটি শুনানির জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু বারবার বেঞ্চ পুনর্গঠিত হওয়ায় শুনানি শেষ করা সম্ভব হয়নি। দ্রুতই মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য নতুন কোনও বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেওয়া হবে বলে জানান তারা।