বৈধভাবে কাজে গিয়েও মালয়েশিয়ায় মানবেতর জীবন

‘হঠাৎ গত ১৩ মার্চ সকালে আমাদের রুমে মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন পুলিশ প্রবেশ করে। আমাদের কাছে পাসপোর্ট এবং আনুষঙ্গিক কাগজপত্র চায়। কিন্তু আমরা জানাই—মালয়েশিয়ায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পাসপোর্ট নিয়োগকর্তার প্রতিনিধি নিয়ে গেছে। আমরা পাসপোর্টের ফটোকপি দেখাই। তাতে তারা দেখতে পায় ভিসার মেয়াদ শেষ আর আমাদের আটক করে নিয়ে যায় ডিটেনশন সেন্টারে। নিয়োগকর্তার এজেন্টকে পুলিশ ফোন দিলেও সে আসেনি।’

নিজেদের পরিস্থিতির কথা এভাবেই বর্ণনা করছিলেন কাজের উদ্দেশ্যে বৈধভাবে মালয়েশিয়ায় গিয়ে মানবেতর সময় ভোগ করা মাজেদ। গতবছরের ২৯ ডিসেম্বর এয়ার এশিয়ার একটি ফ্লাইটে ৪৭ জন বাংলাদেশি কর্মী শ্রম অভিবাসন চুক্তির আওতায় মালয়েশিয়ায় যান। ‘ইলুমিনাস ইঞ্জিয়ারিং’ নামে একটি কোম্পানির কারখানার কাজ করার উদ্দেশ্যে তারা ঢাকা ছাড়েন। পরদিন ভোরেই তারা সেই দেশে পৌঁছালে একজন মালয়েশিয়ান নারী তাদের রিসিভ করেন এবং তাদের পাসপোর্ট নিজের হেফাজতে নিয়ে নেন।

মাজেদের ভাষ্য, ওই নারীর সঙ্গে তখন বাংলাদেশি এক এজেন্টও ছিলেন, যার নাম আজিজ। তিনি নিজেকে বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি গ্রিনল্যান্ড ওভারসিজের প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করেন। এই কর্মীরা ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচ করে মালয়েশিয়ায় গেছেন। কেউ কেউ এই টাকা পরিশোধ করতে নিয়েছেন ঋণ। তবে সেখানে গিয়ে তারা কাঙ্ক্ষিত কাজ পাননি। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে আটক করে মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন পুলিশ। দিনের পর দিন তারা সেখানে মানবেতর জীবন পার করেন। আর বাইরে যারা ছিলেন, তাদের অবস্থা আরও শোচনীয়।

কাজে যোগ দিতে না পেরে এজেন্ট আজিজের সঙ্গে যোগাযোগ করেন মাজেদ ও তার সহকর্মীরা। আজিজ তাদের আশ্বাস দেয়, দুই দিনের মধ্যে কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের নিয়োগ দেওয়া হবে। কিন্তু তিন মাস পার হয়ে গেলেও তা হয়নি এবং সেই কোম্পানির পক্ষ থেকে কেউ এখনও যোগাযোগও করেনি। তিন মাস ধরে মালয়েশিয়ায় তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

মাজেদ ও অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ৩০ ডিসেম্বর বিমানবন্দর থেকে তাদের ৪৭ জনকে সেরি কেম্বাঙ্গান এলাকার একটি আবাসিক ফ্ল্যাটে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ঘুমানোর জন্য কোনও বিছানা ছিল না। আর সবার ব্যবহারের জন্য ছিল একটি টয়লেট, তারও অবস্থা বেশি ভালো না। একটি ফ্ল্যাটে অনেক সমাগম দেখে প্রতিবেশীরা ফোন দিয়ে পুলিশকে ডাকে। পরে স্থানীয় পুলিশ সেই ফ্ল্যাটে আসে। পুলিশ আসায় তাদের ২১ জানুয়ারি সেখান থেকে স্থানান্তর করে কেপাং এলাকায় ‘গ্রিন টি’ নামক একটি হোটেলে রাখা হয়। সেখানে তাদের আশ্বস্ত করা হয় যে, তিন দিনের মধ্যে তাদের কাজে নিয়োগ দেওয়া হবে। কিন্তু তেমন কিছু না হওয়ায় তারা কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাই কমিশনে যোগাযোগের চেষ্টা করে কর্মীরা। যোগাযোগ করার পর ১ ফেব্রুয়ারি হাই কমিশনের প্রতিনিধি তাদের সঙ্গে দেখা করতে আসে এবং এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করে কাজে নিয়োগ দেওয়ার কথা জানায়। একই সঙ্গে তাদের প্রত্যককে ৫০ রিঙ্গিত করে দেয়।

বৈধভাবে কাজে গিয়েও মালয়েশিয়ায় মানবেতর জীবন

এরপর ২ ফেব্রুয়ারি তাদের সবাইকে একটি বাসে করে পেনাং নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাদের ১০, ১৭ এবং ২০ জনের আলাদা গ্রুপ করা হয়। এই তিনটি গ্রুপকে ভিন্ন তিনটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে রিক্রুটিং এজেন্সির কোন প্রতিনিধি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। অন্যদিকে তাদের ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে যায়। তাছাড়া তাদের তিন বেলা ভালো খাবারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও দুই বেলা খাবার তাও খাওয়ার অযোগ্য এমন খাবার দেওয়া হয়। 

এদের মধ্যে ১০ জনকে গত ১৩ মার্চ গ্রেফতার করে নিয়ে যায় মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন পুলিশ। এসময় তাদের নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন কর্মীরা। পরে গত ২২ মার্চ মুক্তি পান তারা। ভুক্তভোগীরা জানান, আটকের পর দুই-তিন দিন তাদের পুলিশ স্টেশনেই রাখা হয়। তৃতীয় দিন তাদের ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। ক্যাম্পে তাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ এবং শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ করেন তারা।  
ভুক্তভোগীরা সাহায্যের জন্য অভিবাসন নিয়ে কাজ করা ব্রিটিশ অ্যাক্টিভিস্ট এন্ডি হলের শরণাপন্ন হন। তিনি এ নিয়ে আওয়াজ তুললে স্থানীয় গণমাধ্যমে তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অমানবিক ঘটনার বর্ণনা প্রকাশ করে।

এন্ডি হল জানান, বাংলাদেশি এই কর্মীরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়া দুই দেশেই তারা শোষণের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচ করে এখানে এসে জেল খেটেছে, ঠিকমতো খাবার পর্যন্ত পায়নি তারা। গত চার মাস ধরে তারা নির্মম সময় পার করছে এখানে।

গাদাগাদি করে থাকতে হয়েছে এই কক্ষে

ভুক্তোভোগীদের বিষয়ে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাই কমিশনার গোলাম সারোয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় গনমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘এসব কর্মীর নিয়োগকর্তাকে তলব করেছে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়। নিয়োগকর্তার কাছে মন্ত্রণালয় ব্যাখ্যাও চেয়েছে, কেন তারা চাকরি দিতে পারছে না।’

তিনি আরও দাবি করেন, ‘হাই কমিশনের পক্ষ থেকে কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা গুরুত্ব দেয়নি।’ তবে এই ধরনের পরিস্থিতি খুব দ্রুত নিষ্পত্তি হবে, কর্মীরা কাজে ফিরে যেতে পারবেন বলেও আশা ব্যক্ত করেন তিনি।

মালয়েশিয়া গিয়ে কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপনের ঘটনা নতুন নয়। কয়েকদিন আগে নেগ্রি সেম্বিলানের একটি ট্রানজিট হোম থেকে ২২৬ বাংলাদেশি এবং নেপালি কর্মীকে উদ্ধার করে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়। সেই ট্রানজিট হোমে মানবেতর জীবনযাপন করছিল তারা। দেশটির মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সেখানে গিয়ে দেখতে পান, এমন পরিবেশে বসবাস খুবই বিপদজনক। অভিযানের পর মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী শিব কুমার জানান, তারা (কর্মীরা) খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং কান্নাকাটি করছিলেন।

পরে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের অভিযোগের প্রসঙ্গেও কথা বলেন মানবসম্পদমন্ত্রী। তিনি জানান, বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছ থেকে অভিযোগ প্রাপ্তির পর সেখানে অভিযানে যায় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

বিপদে পড়া এই কর্মীরা মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন বাংলাদেশের গ্রিনল্যান্ড ওভারসিজের মাধ্যমে। তাদের দুর্দশার কথা বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল্লাহ আল মামুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সবাই কাজে চলে গেছে। কয়েকজন জেলে ছিল, তারাও বের হয়ে গেছে।’

পরে আবার কর্মীদের কাছে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই দেশে আমরা কোনোরকম বেঁচে আছি। ঠিকমতো খাবার নেই, এমনকি পানিও নেই। রাতের বেলা পানির পিপাসা লাগলে টয়লেট থেকে পানি এনে খাই। না পারতেছি বাঁচতে, না পারতেছি মরতে। ঋণের টাকা নিয়ে এখানে আসছিলাম। কোনও কাজ জোগাড় না হলে আত্মহত্যা ছাড়া পথ থাকবে না।’

এদিকে মালয়েশিয়া গিয়ে কাজ পাচ্ছেন না কর্মীরা— এমন তথ্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে জানালে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, ‘আমাদের কাছে এমন কোনও তথ্য নেই। যদি এমনটা হয়, প্রত্যেকটি অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে।’