যে যার মতো দিচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য, নেই সমন্বিত ডাটাবেজ

সড়ক দুর্ঘটনার সঠিক পরিসংখ্যান নেই কারও কাছে। সরকারি-বেসরকারি যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তারা নিজেদের মতো করে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে। প্রতিবছর তা গণমাধ্যমে ফলাও করে তুলে ধরা হয়। কিন্তু এত বছরেও বিআরটিএ সড়ক দুর্ঘটনার কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ তৈরি করতে পারেনি। এতে দুর্ঘটনার সঠিক তথ্য উঠে আসছে না।

তবে দুর্ঘটনার সঠিক তথ্য তুলে ধরার জন্য কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ থাকা দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে বলেও জানান তারা।

রাজধানী কিংবা বিভিন্ন মেট্রো এলাকা ছাড়াও দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতাল ছাড়াও বেসরকারি যেসব হাসপাতাল রয়েছে, সেসব হাসপাতালে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক বা মাসিক দুর্ঘটনায় চিকিৎসা নেওয়ার তথ্য উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও এবং জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক হয়ে বিআরটিএ কার্যালয়ে পাঠানো হলে দুর্ঘটনার সঠিক তথ্য উঠে আসবে। এ জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে কার্যকর ভূমিকা রাখার কথা বলেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, দুর্ঘটনা যেখানে ঘটুক না কেন, উপজেলা, জেলা কিংবা থানা পর্যায়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে সবাই চিকিৎসা নিতে স্থানীয় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে যায়। এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে আরও কার্যকরী হওয়ার কথা বলেন তারা।

বেসরকারিভাবে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা), রোড সেফটি ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি সড়ক দুর্ঘটনার বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে এবং বছর বছর তা প্রকাশ করে। এ ছাড়া পুলিশ বিভিন্ন দুর্ঘটনার যেসব বিষয় থানায় মামলা কিংবা জিডি হয়, এসব বিষয় ছাড়া আর কোনও বাড়তি তথ্য তাদের কাছে থাকে না। ২০২৩ সালের শুরু থেকে সড়ক দুর্ঘটনার বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে তা প্রকাশ করা শুরু করেছে বিআরটিএ। কিন্তু একেকজন একেকভাবে তথ্য সংগ্রহ করার ফলে দেখা দেয় তারতম্য।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির ২০২২ সালের তথ্যে দেখা যায়, ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৯ হাজার ৯৫১ জন। আহত ১২ হাজার ৩৫৬। এরমধ্যে রেলপথে ৬০৬টি দুর্ঘটনায় ৫৫০ জনের মৃত্যু হয় ও আহত হয় ২০১ জন। নৌপথে ২৫২টি দুর্ঘটনায় নিহত ৩৫৭ ও আহত ৩১৮ এবং নিখোঁজ ৭৪৩ জন। দেশের জাতীয়, আঞ্চলিক ও অনলাইন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সড়ক, রেল ও নৌ-দুর্ঘটনার সংবাদ মনিটর করে এই প্রতিবেদন তৈরি করে সংস্থাটি।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ২০২২ সালের তথ্যে দেখা যায়, ৬ হাজার ৮২৯টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৭ হাজার ৭১৩ জন, আহত হয়েছে ১২ হাজার ৬১৫ জন। এরমধ্যে ১৯৭টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৩১৯ জন নিহত, আহত হয় ৭৩ জন এবং নিখোঁজ ৯২ জন। ৩৫৪টি রেল দুর্ঘটনায় ৩২৬ জনের মৃত্যু হয়, আহত হয় ১১৩ জন। ৯টি জাতীয় দৈনিক, সাতটি অনলাইন পোর্টাল ও টিভি চ্যানেলের খবরের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে সংস্থাটি।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৫ হাজার ৭০ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫ হাজার ৭৬০‌ জন এবং আহত হয়েছে ৭ হাজার ৩৩১ জন। এরমধ্যে ৭৭টি নৌ-দুর্ঘটনায় নিহত ২০৪, আহত ১৪৪ ও নিখোঁজ ১৮৬‌। ২৫৬ রেল দুর্ঘটনায় মারা যায় ২৭০ জন, আহত হয়েছে ৫১ জন। ১১টি জাতীয় বৈদ্যুতিন মিডিয়া, অনলাইন, শাখা সংগঠনের প্রতিবেদন, অনুমেয় বা অপ্রকাশিত ঘটনার ভিত্তিতে তৈরি করা হয় নিসচার এই প্রতিবেদন।

বিআরটিএ, পুলিশ ও বেসরকারি যেসব সংগঠন রয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন তৈরি করে সমন্বিত একটি ইউনিক ডাটা ব্যাংক তৈরি করতে হবে (ছবি: বাংলা ট্রিবিউন)

২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চের তথ্যেও সড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যা ও নিহতের সংখ্যার তারতম্য দেখা গেছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে মার্চে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৮৭টি, নিহত ৫৩৮ আর আহত ১ হাজার ১৩৮; রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে ৪৮৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৫৬৪, আহত ১০৯৭। আর বিআরটিএ’র প্রতিবেদনে উঠে আসে ৩৮৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৪১৫ ও আহত ৬৮৮ জন।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে গত ফেব্রুয়ারিতে ৪৪৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৪৬৭ জন ও আহত ৭৭১ জন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে ৪৩৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৮৭ জন নিহত এবং আহত ৭১২ জন। বিআরটিএ’র প্রতিবেদনে ৩৩৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৩০৩ ও আহত ৪১৬।

জানতে চাইলে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা যখন সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন তৈরি করি, অনেক জায়গা থেকেই তথ্য সংগ্রহ করে থাকি। যতটুকু সম্ভব বস্তুনিষ্ঠ করার চেষ্টা করি। আমরা চেয়েছিলাম বিআরটিএ, পুলিশ ও বেসরকারি যেসব সংগঠন রয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন তৈরি করে সমন্বিত একটি ইউনিক ডাটা ব্যাংক তৈরি করতে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত তেমন কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আমরা মনে করি তথ্য ব্যাংক থাকা দরকার। দুর্ঘটনার প্রতিরোধমূলক কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তথ্য না থাকলে তা জানা সম্ভব নয়।

তিনি আরও বলেন, দেখা গেছে সংশ্লিষ্ট থানায় যেসব মামলা থাকে, পুলিশ সেসব তথ্য লিপিবদ্ধ করে, আর কোনও তথ্য তাদের কাছে থাকে না। বিআরটিএ সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য প্রতিবেদন সংগ্রহ করা শুরু করেছে। যদিও পুলিশ, বিআরটিএ বা অন্যান্য সংস্থার তথ্যে কোনও মিল নেই। বিআরটিএ তথ্যের সঙ্গে আমাদের বেসরকারি সংগঠনগুলোর তথ্যের মিল না থাকায় বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ কিছুটা ক্ষুব্ধ হয় আমাদের ওপর। আবার পুলিশ ও বিআরটিএ প্রতিবেদনের সংখ্যা নিয়েও তারতম্য দেখা গেছে। দুটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও যদি তথ্যের মিল না থাকে, তাহলে আমাদের বেসরকারি সংগঠনগুলোর সঙ্গে তথ্যের মিল থাকার তো কোনও সুযোগ থাকে না।

দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতাল ছাড়াও বেসরকারি যেসব হাসপাতাল রয়েছে, সেসবের তথ্যও বিআরটিএতে পাঠালে সঠি তথ্য পাওয়া সম্ভব (ফাইল ছবি)

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সারা দেশে বিআরটিএ’র যেসব অফিস রয়েছে, সেসব অফিস থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকার দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে সদর দফতরে পাঠানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা প্রতিদিনের সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে থাকি। তবে এখন পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি সংগঠনগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে ডাটা ব্যাংক করার কোনও পরিকল্পনা নেই। সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কথা বলে এসব বিষয়ে পরবর্তী সময়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা ভবিষ্যতে বলা যাবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সহকারী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার সঠিক তথ্য নির্ণয়ের জন্য একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ থাকা প্রয়োজন। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা তথ্য সংগ্রহের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তবে সমন্বিত কোনও ডাটাবেজ না থাকায় বিভিন্ন সময় ঝামেলা তৈরি হয়।

তিনি আরও বলেন, বিআরটিএ, পুলিশ, স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে ডাটাবেজ তৈরি করা প্রয়োজন। একটি ফরমেট রেডি করা থাকবে, সে ফরমেটে সবাই সবার মতো তথ্য দেবে। পরে এসব তথ্য ডাটাবেজে সঠিকভাবে যুক্ত হবে বলে জানান তিনি।