শিল্পচর্চা ও বিকাশের বাতিঘর জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা

আধুনিক শিল্পধারার প্রাণপুরুষ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। শিল্পকর্ম দিয়ে বাংলাদেশের শিল্পকলাকে আন্তর্জাতিক মণ্ডলে সম্মানজনক আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে বটবৃক্ষের ছায়ায় বসে ছবি আঁকতেন শিল্পী। এসব সৃষ্টিকর্ম প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছে দিতে শিল্পীর শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত ব্রহ্মপুত্র নদ তীরবর্তী এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা। এটি এখন শিল্পচর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। শিল্পীর আঁকা ছবি দেখতে প্রতিদিন ভিড় করছেন শিক্ষার্থীসহ নতুন প্রজন্মের মানুষজন।

শিল্পীর সৃষ্টিকর্ম দেখে দারুণ খুশি দর্শনার্থীরা। সেইসঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক সংগ্রহশালা তৈরির দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় শিল্পীরা। সংগ্রহশালার দায়িত্বশীলরা বলছেন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালাকে ঘিরে সাংস্কৃতিক পল্লি গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে।

জয়নুল আবেদিনের জন্ম

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলায় ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন জয়নুল আবেদিন। বাবা তমিজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর, মা জয়নাবুন্নেছা গৃহিণী। নয় ভাইবোনের মধ্যে জয়নুল ছিলেন সবার বড়। পড়াশোনায় হাতেখড়ি পরিবারেই। ছোটবেলা থেকে ছবি আঁকতেন। পাখির বাসা, পাখি, মাছ, গরু-ছাগল, ফুল-ফল এঁকে মা-বাবাকে দেখাতেন। শৈশব-কৈশোরের ও জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে ময়মনসিংহ শহরে। 

সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা

ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে শিল্পীর সম্পর্ক গভীর। যা সৃষ্টিকর্ম থেকেই সহজে বোঝা যায়। এসব সৃষ্টিকর্ম নিয়ে ময়মনসিংহ শহরের উত্তর পাশ দিয়ে প্রবহমান পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ এপ্রিল তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংগ্রহশালার উদ্বোধন করেন। সে সময় দেশব্যাপী জয়নুলের বিভিন্ন শিল্পকর্ম সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। 

২০০৬ সালে সংগ্রহশালা নতুন করে সাজানো হয়। নিচতলায় ব্যবস্থাপনা কক্ষসমূহ এবং দোতলায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছবির গ্যালালি স্থাপন করা হয়। মূল ভবনের পেছন ভাগে ব্যবস্থাপকদের বাসস্থানের সঙ্গে সঙ্গে তিনটি কুটির স্থাপন করা হয়েছে। যা শিল্পরসিকদের সাময়িক আবাসনের জন্য ব্যবহার করা হয়।

সংগ্রহশালায় যা যা আছে

সংগ্রহশালায় প্রথমে ৭০টি চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছিল। যার বেশিরভাগই তৈলচিত্র। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে আছে- বিভিন্ন দেশ ভ্রমণকালে শিল্পাচার্যের অঙ্কিত ছবি, গুণটানা, নদী পারাপারের অপেক্ষায় পিতা-পুত্র এবং দুর্ভিক্ষ। এখান ১৭টি অতি আকর্ষণীয় ছবি ১৯৮২ সালে চুরি হয়ে যায়। এর মধ্যে ১০টি ছবি ১৯৯৪ সালে আবারও উদ্ধার করা হয়। বর্তমানে এখানে ৬২টি চিত্রকর্ম রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে শিল্পাচার্যের ব্যবহৃত জিনিস এবং তার কিছু স্থিরচিত্র। স্থিরচিত্রগুলো ভবনের দোতলার বারান্দায় রয়েছে। 

জয়নুল আবেদিনের ভাস্কর্য

১নং গ্যালারি

শম্ভুগঞ্জ ঘাট, শম্ভুগঞ্জ ব্রিজ, স্কেচ, স্কেচ, স্কেচ, স্কেচ, স্কেচ, স্কেচ (বংশীবাদক), বাস্তুহারা, প্রতিকৃতি, প্রতিকৃতি, স্কেচ, মহিষের বাচ্চা, কাজী নজরুল ইসলাম, কংকালসার, দুর্ভিক্ষ, দুর্ভিক্ষ, দুর্ভিক্ষ, রমনী-১, ১৯৫১, কাগজে টেম্পোরা, মা ও ছেলে- ১৯৫১, কাগজে টেম্পোরা, কলসী কাঁখে-১৯৫১, কাগজে টেম্পোরা, স্নান শেষে-১৯৫১, কাগজে টেম্পোরা, মা ও শিশু-১৯৫৩, কাগজে টেম্পোরা, তিন রক্ষী-১৯৫৩, কাগজে টেম্পোরা, চিন্তা-১৯৫৩, কাগজে টেম্পোরা, চিন্তা-১৯৫৩ (২)।

তার বিখ্যাত চিত্রকর্মের মধ্যে রয়েছে দুর্ভিক্ষ চিত্রমালা, নবান্ন, ফসল মাড়াই, সংগ্রাম, সাঁওতাল রমণী, ঝড়, কাক ও বিদ্রোহী ইত্যাদি।

২নং গ্যালারি

এতে রয়েছে শিল্পাচার্যের ব্যবহার্য জিনিসসমূহ। সেগুলো হলো—জুতা, কোট, রংতুলি, চিত্রপট, কলম, শার্ট, প্যান্ট ও খাট ইত্যাদি। সংগ্রহশালায় এলে তার অনবদ্য সৃষ্টিগুলোর দেখা মিলবে।

নতুন শিল্পী তৈরিতে অবদান

স্থানীয় শিল্পীরা বলছেন, জয়নুল সংগ্রহশালার চিত্রকর্ম দেখে অনেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে চারু-শিল্পচর্চায় উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। এ জন্য আধুনিক সংগ্রহশালা তৈরি করা জরুরি।

এসব রং লাগানোর তুলি দিয়ে ছবি আঁকতেন শিল্পী

এখানে শুধু শিশু শিল্পীদের আর্ট শেখানো হয় জানিয়ে স্থানীয় চিত্রশিল্পী মো. রাজন বলেন, ‌‘এর পাশাপাশি শিল্পীদের ছবির প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা দরকার। সেইসঙ্গে শিল্পীদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা রেখে শিল্পকর্ম চর্চার ব্যবস্থা করার দাবি জানাই।’ 

জয়নুল সংগ্রহশালা নতুন শিল্পী তৈরিতে অবদান রাখছে উল্লেখ করে চিত্রশিল্পী বিশ্বজিৎ কর্মকার বলেন, ‘জয়নুলের আঁকা দুর্লভ সব ছবি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এতে শিল্পের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বে।’

সংগ্রহশালার আর্ট স্কুল

জয়নুল সংগ্রহশালার আর্ট স্কুল থেকে লেখাপড়া করে শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্বপালন করছেন। শিক্ষার্থীদের সেভাবে শিল্পকর্ম শেখানো হচ্ছে বলে জানালেন সংগ্রহশালার আর্ট স্কুল শাখার প্রধান শিক্ষক বাদল চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আদর্শকে ধারণ করে চিত্রকর্ম শিখে এগিয়ে যাচ্ছে নতুন প্রজন্ম।’

বিদ্রোহী, শিল্পীর আঁকা ছবি

শিল্পচর্চার বাতিঘর

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন রং তুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছিলেন গ্রামবাংলার আবহমান চিত্র থেকে শুরু করে দুর্ভিক্ষসহ দুস্থদের জীবন-সংগ্রাম। অসাধারণ এসব সৃষ্টিকর্ম রক্ষিত রয়েছে এই সংগ্রহশালায়, এটি শিল্পচর্চার বাতিঘর—এমনটি জানিয়েছেন সংগ্রহশালার উপ-কিপার মুকুল দত্ত।

তিনি বলেন, ‘জয়নুল আবেদিনের উদ্দেশ্য ছিল শিল্পকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেওয়া। এই লক্ষ্যে সংগ্রহশালা ও আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।’ 

সংগ্রহশালার গ্যালারিতে জয়নুল আবেদিনের আঁকা ৬২টি ছবি আছে জানিয়ে মুকুল দত্ত বলেন, ‘এর পাশাপাশি স্মৃতি হিসেবে ৩৫টি পোশাকসহ অন্যান্য নিদর্শন আছে ১২৭টি এবং টেপা পুতুল আছে ১২টি।’

শিল্পীর সৃষ্টিকর্ম দেখে দারুণ খুশি দর্শনার্থীরা

জয়নুলের প্রতিষ্ঠিত আর্ট স্কুল শিল্পচর্চায় ভূমিকা রাখছে জানিয়ে মুকুল দত্ত আরও বলেন, ‘জয়নুলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছি আমরা। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এই সংগ্রহশালা ঘিরে সাংস্কৃতিক পল্লি গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন। সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।’

সাংস্কৃতিক পল্লি গড়ে তোলার উদ্যোগ

সাংস্কৃতিক পল্লি গড়ে তোলার খবরে খুশি স্থানীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। স্থানীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শাহাদাত হোসেন খান হিলু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সাংস্কৃতিক পল্লি গড়ে উঠলে এখানে সব ধরনের সাংস্কৃতিক চর্চা হবে এবং শিল্পীরা লাভবান হবেন। প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক সাংস্কৃতিক পল্লি গড়ে উঠার মাধ্যমে সংস্কৃতিকর্মীদের মিলনমেলায় রূপ নেবে এই সংগ্রহশালা—এমনটি আমাদের প্রত্যাশা।’