From a small village of Bihar to West Indies Tour, Taxi driver son Mukesh Kumar continues his inspirational journey

সব্যসাচী বাগচী 

ছুটির মেজাজে রয়েছেন। আর তাই নিজের মতো করে সময় কাটানোর জন্য তাঁর গাড়ি ছুটে যাচ্ছিল বৈদ্যনাথ ধামের দিকে। সঙ্গী তাঁর মা মালতি দেবী। জি ২৪ ঘণ্টার তরফ থেকে বঙ্গ পেসারকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য ফোন করা হলে, প্রথমে খবরটা বিশ্বাস করতে পারেননি মুকেশ কুমার (Mukesh Kumar)! এই প্রতিবেদককে থামিয়ে নিজের মোবাইলে চোখ রাখতেই কিছুক্ষণ চুপ থেকে গেলেন তরুণ জোরে বোলার। এরপর অস্ফুটে বললেন, “আমি ভেবেছিলাম আপনি মজা করছেন। তবে বিসিসিআই-এর (BCCI) টুইটার দেখে মন-মেজাজ ভালো হয়ে গেল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের (West Indies) বিরুদ্ধে একইসঙ্গে টেস্ট ও একদিনের দলে সুযোগ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। কী যে বলব, ভাবতেই পারছি না। যেন গায়ের রোম খাড়া হয়ে গিয়েছে।” 

মুকেশের সঙ্গে এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। রাজকোটে সৌরাষ্ট্র ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের স্টেডিয়ামে সৌরাষ্ট্রর বিরুদ্ধে ইরানি ট্রফির দ্বিতীয় দিনের ম্যাচ খেলে টিম হোটেলে ফিরে গিয়েছেন। তখনও জানতেন না সুখবরটা। মোবাইলে হঠাৎ করে টিম ইন্ডিয়ার (Team India) অফিসিয়াল হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হওয়ার বার্তা। তখনই জানতে পারেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে একদিনের সিরিজে ভারতীয় দলে ডাক পেয়েছেন। ভারতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার খবর জানতে পেরেই সেবার একইরকম ভাবে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন মুকেশ। বাংলার এই ক্রিকেটারের মনে পড়ছিল প্রয়াত বাবার কথা। এবারও তেমনই অনুভূতি। এমনটা হওয়াও স্বাভাবিক। কারণ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (Sourav Ganguly) ও মহম্মদ শামির (Mohammed Shami) বাংলার তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট এবং একদিনের ফরম্যাটে জায়গা করে নিলেন। 

ছেলে বড় ক্রিকেটার হতে পারে, ভারতীয় দলে সুযোগ পেতে পারে, কখনও এমনটা মনে করতেন না মুকেশের প্রয়াত বাবা কাশীনাথ সিং। গতবছর ব্রেন স্ট্রোকে মারা যান মুকেশের বাবা কাশীনাথ। নিজে ট্যাক্সি চালালেও, ছেলেকে সরকারি চাকরির জন্য পড়াশোনা করার কথা বলতেন। সেই ছেলেই এবার জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছেন। ভারতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পর বাবার কথা স্মরণ করে মুকেশ বলেন, “খবরটা জানার পর আমি খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি। চোখের সামনে প্রয়াত বাবার মুখটাই বারবার ভেসে উঠছে। বাংলার হয়ে রঞ্জি ট্রফি খেলার আগে পর্যন্ত বাবা বিশ্বাস করতেন না যে, পেশাদার ক্রিকেট খেলার জন্য আমি উপযুক্ত। ভারতীয় দলে সুযোগ পেয়ে আমার স্বপ্নপূরণ হল। বাবা যদি বেঁচে থাকতেন তবে তিনি সবচেয়ে খুশি হতেন। কারণ ওনার কাছে টেস্ট ক্রিকেটই হল শেষ কথা।” 

মুকেশ ফের বলছিলেন, “পরবর্তী সময় আমার ইচ্ছাকে মেনে বাবা ক্রিকেটকে পছন্দ করতে শুরু করেছিল। আমার মা ক্রিকেট সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। তবে আমার পরিশ্রম দেখে, ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিন অনুশীলন করতে দেখে সবসময় আমার জন্য প্রার্থনা করতেন। সেই দিনগুলো খুব মনে পড়ছে। শুধু আমার লড়াই নয়। বাবা-মা’র ত্যাগ ও আশীর্বাদের জন্য এতটা লম্বা রাস্তায় হাঁটতে পারলাম।” 

আরও পড়ুন: Rohit Sharma, WI vs IND: রোহিত-বিরাটকে রেখে দল গড়লেও বিশ্রামে পূজারা-শামি, সুযোগ পেলেন বাংলার মুকেশ

আরও পড়ুন: EXCLUSIVE, IND vs PAK: অনীহা থাকলেও আহমেদাবাদেই টিম ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে বাবরদের মহারণ, হাইব্রিড মডেলে হবে এশিয়া কাপ

বিহারের গোপালগঞ্জের কাকরকুণ্ডে জন্ম মুকেশের। অনূর্ধ্ব ১৯ পর্যায়ে বিহারের হয়ে প্রতিনিধিত্বও করেছেন। ছোট বেলায় স্বপ্ন দেখতেন আর্মিতে যোগ দেওয়ার। চেষ্টাও করেছিলেন। শারীরিক পরীক্ষায় তিন–তিনবার ব্যর্থ হন। ২০১২ সালে এক দুর্ঘটনার কবলে পড়েন মুকেশ। এরপর বাবা তাঁকে কলকাতায় এসে কাজ করার কথা বলেন। কলকাতায় এসে কাজ করার পাশাপাশি ক্রিকেট খেলাও চালিয়ে যান মুকেশ। সেখান থেকেই স্বপ্ন দেখা শুরু  করেছিলেন। যে স্বপ্ন সবে একটা ধাপ পেরিয়েছে। 

এহেন মুকেশ কয়েক সপ্তাহ আগে বিশ্ব টেস্ট ফাইনালের দলে স্ট্যান্ডবাই বোলার হিসেবে ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ফাইনালে নামার আগে বিরাট কোহলি (Virat Kohli)-রোহিত শর্মাদের (Rohit Sharma) লাগাতার নেটে বোলিং করেছেন বঙ্গ পেসার। কিছু আলাদা পরামর্শ পেয়েছিলেন? মুকেশের মুখে এল টিম ইন্ডিয়ার বোলিং কোচ পারশ মাম্বরে ও রোহিতের নাম। মুকেশ বলছিলেন, “নেটে বোলিং করার সময় পারশ স্যর আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কীভাবে পুরনো বলে রিভার্স সুইং করতে হয়, সেই সময় কেমন রান-আপ দরকার, রান আপের সময় বাঁ হাতে বল থাকলেও, ডেলিভারির সময় কীভাবে হাত বদল করতে হয়, সেটা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এমনকি রোহিত এবং বিরাট ভাই-ও সাহায্য করছেন। কোন জায়গায় বল ফেললে, ব্যাটাররা সমস্যায় পড়তে পারে সেটা আমাকে আরও ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন।” 

২০১৪ সালে বাংলার ‘ভিশন ২০২০’ প্রোজেক্টের জন্য ট্রায়ালে ডাক পান মুকেশ। বোলিংয়ের জন্য তাঁকে যখন ডাকা হয়েছিল, তিনি বাথরুমে গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত পরে মুকেশকে বোলিং করার সুযোগ দেওয়া হয়। তাঁর বোলিংয়ে মুগ্ধ হয়ে ‘ভিশন ২০২০’ শিবিরে মুকেশকে সুযোগ দেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং ওয়াকার ইউনিস। ক্লাব ক্রিকেটে দুরন্ত বোলিং করে ২০১৫ সালে বাংলার সিনিয়র দলে সুযোগ পান মুকেশ। আর তাই মুকেশের কাছে ‘গড ফাদার’ হলেন মহারাজ। এহেন মুকেশ ফের যোগ করলেন, “সেই সময় সৌরভ স্যর, রণদেব বসু, জয়দীপ মুখোপাধ্যায় পাশে না দাঁড়ালে আমি ভেসে যেতাম।” 

একটা সময় পুষ্টির অভাবে বোন এডিমা হয়ে যায়। ক্রিকেট খেলা তো দূর, ঠিক ভাবে হাঁটতেও পারতেন না। ক্রিকেট কিট ছিল না। সেটা মনোজ তিওয়ারি দিয়েছিলেন। ক্রিকেট কেরিয়ার জুড়ে ঝড়-ঝঞ্ঝা এসেছে, কিন্তু কোনও কিছুই মুকেশকে দমাতে পারেনি। মুকেশ বলেন, “যদি কঠিন সময় না আসত, তাহলে হয়তো এই জায়গায় পৌঁছতে পারতাম না। ওই পরিস্থিতিগুলো আমাকে আরও বেশি শক্তিশালী করেছে।” 

কথাগুলো ভাবলে মুকেশের এখনও চোখে জল আসে। বড্ড কাতর হয়ে পড়েন। গলা ধরে আসে। আইপিএল নিলামে দিল্লি ক‌্যাপিটালস যখন তাঁকে সাড়ে পাঁচ কোটি দিয়ে কিনল, লাইভ দেখতে পারেননি। বন্ধুবান্ধবদের ফোনে জানতে পারেন। বাবা কোনওরকমে টেনেশুনে সংসার চালাতেন। তালতলার ওই ছোট্ট বাড়িতে ক্রিকেট মানে তখন বিলাসিতা। বাবাও যে প্রথম প্রথম মুকেশের ক্রিকেট প্রেম নিয়ে খুব একটা খুশি ছিলেন সেটা নয়। একটা সময় ম্যাচ খেলে পাঁচশো টাকা পেতেন। ধার করা কিটে চালিয়ে গিয়েছেন অনুশীলন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ক্যারিনবিয়ান সফরে গিয়ে মুকেশ দুই ফরম্যাটেই অভিষেক ঘটাবেন। ছোট থেকেই মুকেশ একটা স্বপ্ন দেখতেন। ভারতীয় দলের জার্সিতে তিনি খেলবেন। সেই স্বপ্নের অনেকটাই পূরণ হয়েছে। পারফর্ম করে মহম্মদ শামির মতোই জাতীয় দলে জায়গাটা এখন নিয়মিত করতে চান। বাকিটা সময় বলবে। 

(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)