History of Darjeeling Mail- ইতিহাসের শিকড় ছুঁয়ে ছুটে চলেছে দার্জিলিং মেল

‘দার্জিলিং মেল, আজভি অওর কালভি’ হ্যাঁ, এমনই শোনা যেত আগেকার দিনে। এত বিলাসবহুল রেলযাত্রার আয়োজন ছিল না, ছিল না এত ব্যাপক সংখ্যক ট্রেনও। এক শতাব্দীর ইতিহাস নিয়ে আজও ছুটে চলেছে দার্জিলিং মেল। উত্তরবঙ্গে এক সময় চলতি কথা ছিল, দার্জিলিং মেলের আগমনের সঙ্গে নিউজলপাইগুড়ি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে আর সন্ধ্যায় স্টেশন ছেড়ে গেলে ঘুমায় নিউ জলপাইগুড়ি। শিয়ালদহ-হলদিবাড়ি-শিয়ালদহ দার্জিলিং মেল ভারতের প্রাচীনতম চলমান কিংবদন্তি ট্রেনগুলির মধ্যে একটি, দেশভাগ কিংবা স্বাধীনতা, তার পরবর্তী সকল ইতিহাসের সাক্ষী দার্জিলিং মেল। পুরোনো প্রজন্মের কাছে নস্টালজিয়া এই ট্রেনরুট।  

১৮৭৮ সাল থেকে কলকাতা ও শিলিগুড়ির মধ্যে রেলপথ ছিল। প্রথম ল্যাপটি ছিল ইস্টার্ন বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ের অধীনে তৎকালীন কলকাতা স্টেশন (পরে যার নামকরণ হয় শিয়ালদহ) থেকে পদ্মা নদীর দক্ষিণ তীরে দামুকদহ ঘাট পর্যন্ত প্রায় ১৮৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। যাত্রীরা তখন নদী পার হতেন ফেরিতে করে। যাত্রার দ্বিতীয় ল্যাপটি ছিল উত্তরবঙ্গ রেলওয়ের একটি ৩৬৩ কিলোমিটার মিটার-গেজ লাইন, যা পদ্মার উত্তর তীরে সারাঘাটকে শিলিগুড়ির সাথে সংযুক্ত করত। এই রোমাঞ্চকর রেলযাত্রা আজ আর নেই, মাঝখানে কাঁটাতার, আলাদা আলাদা দেশ, নিয়মও তার ভিন্ন। 

এরপরে পদ্মানদীর ওপর ১.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ হার্ডিঞ্জ সেতু নির্মাণ হয়। ১৯১৬ সালে সেতুর উত্তরের মিটারগেজ অংশটি ব্রডগেজে রূপান্তরিত হয়। এরপরই সমগ্র কলকাতা-শিলিগুড়ি রুটে ব্রডগেজের লাইন চালু হয়। এরপর দার্জিলিং মেইল ছুঁয়ে যেত, শিয়ালদহ-রানাঘাট-ভেড়ামারা-হার্ডিঞ্জ ব্রিজ-ঈশ্বরডি-সান্তাহার-হিলি-পার্বতীপুর-নীলফামারী-হলদিবাড়ি-জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি স্টেশনগুলি। এই ঐতিহাসিক রুটে দার্জিলিং মেল চলত দেশভাগের আগের দিনগুলিতে। দেশভাগের পরও কয়েক বছর এই পথে চলাচল করে দার্জিলিং মেল।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা এবং শিলিগুড়িকে সংযোগ করার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা ছিল পশ্চিমবঙ্গ বা বিহারে গঙ্গার ওপর কোনও সেতু সংযোগ না থাকা। শিলিগুড়িতে যাওয়ার একটি চলতি রুট ছিল সাহেবগঞ্জ লুপ হয়ে রাজমহল, তারপর গঙ্গার ওপারে ফেরি করে অন্য দিকে মণিহারী ঘাট, তারপর মণিহারী, কাটিহার এবং বারসোই হয়ে কিষাণগঞ্জ এবং অবশেষে ন্যারোগেজ দিয়ে শিলিগুড়ি। ১৯৪৯ সালের পর কিষাণগঞ্জ-শিলিগুড়ি অংশটিও মিটারগেজে রূপান্তরিত হয়। ক্রম বিবর্তন ঘটতে থাকে ভারতীয় রেলের। ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে বদলাতে থাকে প্রযুক্তি, ট্রেন রুটও।

১৯৬৫ সালের পর ফারাক্কা ব্যারেজের নির্মাণ আরও বদলে দেয় পরিস্থিতি। ২২৬৫ মিটার দীর্ঘ ফারাক্কা ব্যারেজ গঙ্গানদীর রেল ও সড়ক সেতু নির্মাণে সাহায্য করে। রেল সেতুটি  ১৯৭১ সাল থেকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ফলে বারহারওয়া – আজিমগঞ্জ – কাটোয়া লুপটিকে মালদা টাউন, বারসোই, কিষাণগঞ্জ, নিউ জলপাইগুড়ি এবং উত্তরবঙ্গের অন্যান্য রেলস্টেশনের সাথে সংযুক্ত করা হয়। সেই থেকেই দার্জিলিং মেল চলতে শুরু করল হাওড়া-নিউ জলপাইগুড়ি লাইন ধরে। কত গল্প যে ছড়িয়ে আছে শতাব্দী পেরোনো এই রেলগাড়ির আনাচে-কানাচে, তা জানা হবে না কোনও দিনই। নিত্যনতুন বিলাসবহুল রেলযাত্রা কিংবা দ্রুততম বন্দে ভারত চালু হলেও আজও যাত্রীদের অন্যতম পছন্দ দার্জিলিং মেল, যা মেলবন্ধন ঘটায় মহানগরের সাথে উত্তরবাংলার।