সাড়ে ৫ মাস ওষুধ খাওয়ানোর পর চিকিৎসক বললেন, ‘আপনার যক্ষ্মা হয়নি’

রক্ত পরীক্ষা, কফ পরীক্ষা, সিটিস্ক্যান করার পর টিবি শনাক্ত না হলেও বাংলা ট্রিবিউনের চাঁদপুর জেলা প্রতিনিধি ইব্রাহীম রনিকে সাড়ে পাঁচ মাস যক্ষ্মার চিকিৎসা দিয়েছেন ল্যাবএইড হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রফেসর ডা. আলী হোসেন। সাড়ে পাঁচ মাস ওষুধ খাওয়ার পর অবস্থার অবনতি হওয়ায় আবারও ওই চিকিৎসকের কাছে যান রনি। তখন চিকিৎসক বলেন, ‘এই ওষুধে আপনার কাজ হচ্ছে না, তাই আজ থেকে তা বন্ধ। আরও কিছু টেস্ট করা লাগবে।’

এমন কথা বলে আবারও অনেকগুলো পরীক্ষা করাতে দেন। চিকিৎসকের পছন্দের হাসপাতালে এসব পরীক্ষা করাতে বলেন। তবে এবারের পরীক্ষায় কোনও রোগ ধরা পড়েনি। কোনও রোগ ধরা না পড়ায় আলী হোসেন এবার রনিকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনাকে যক্ষ্মার ওষুধ দিয়েছিল কে? এটা তো যক্ষ্মা নয়। তখন রনি বলেন, ‘আপনি-ই তো দিয়েছিলেন।’ তখন কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েন এই চিকিৎসক।

চিকিৎসক আলী হোসেনের সঙ্গে সবশেষ এই কথোপকথনের অডিও রয়েছে রনির কাছে। এই চিকিৎসকের এ ধরনের কথায় ও চিকিৎসায় হতবাক রোগী। ভুল চিকিৎসায় এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। বর্তমানে গুরুতর অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি রয়েছেন।

রনির স্বজন ও সহকর্মীদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার ফুসফুস দুটি অস্বাভাবিকভাবে ক্ষত হয়ে গেছে। দীর্ঘ সময় ধরে যক্ষ্মার চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ায় এমনটি হয়েছে। বর্তমানে তার চিকিৎসা চলছে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে। দিন দিনই তার ওজন কমে যাচ্ছে। কাশি দিলেই বুকে ব্যথা হচ্ছে। দুর্বলতায় নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছেন এই সাংবাদিক।

রনির স্বজনরা জানান, তার দুটি ফুসফুসে ইনফেকশন রয়েছে বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকরা। কাশি, বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, ক্ষুধামান্দ্য ও এলার্জিজনিত সমস্যায় ভুগছেন রনি। চিকিৎসক আলী হোসেনের ভুল চিকিৎসার কারণে এখন মৃত্যুর মুখে রয়েছেন তিনি।

ভুল চিকিৎসার বর্ণনা দিয়ে সাংবাদিক ইব্রাহীম রনি বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে আমি এলার্জিজনিত সমস্যায় ভুগছিলাম। একপর্যায়ে কাশি শুরু হয়। চিকিৎসক দেখিয়ে ওষুধ খেলেও সমস্যার উন্নতি হচ্ছিল না। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য গত বছরের ২০ ডিসেম্বর ল্যাবএইডের প্রফেসর ডা. আলী হোসেনের কাছে যাই। ওই সময় তিনি এক্স-রে দেখে বলেন, টিবি রোগ হয়েছে। এরপরও আমার অনুরোধে সিটিস্ক্যান, টিবি গোল্ড টেস্ট করাতে বলেন তিনি। এ ছাড়া অন্যত্র স্পুটামের জিন এক্সপার্ট টেস্ট করাই। এসব টেস্টের কোনোটিতেই টিবি পজিটিভ আসেনি। তবু আলী হোসেন আমাকে ছয় মাস টিবির ওষুধ দেন। সাড়ে পাঁচ মাস ধরে ওই ওষুধ খেতে থাকা অবস্থায় শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। অবস্থা খারাপ দেখে গত ৬ জুন আবারও তার কাছে যাই। নতুন এক্স-রে রিপোর্ট দেখে ওই চিকিৎসক বলেন, “আপনার তো ওষুধে কাজ করছে না, আপনার এমডিআর (মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স) হতে পারে।” তখন তিনি আমাকে ব্রংকোস্কপি এবং টিবির স্পুটাম টেস্টসহ ৮ প্রকারের যাবতীয় টেস্ট করাতে বলেন। এক মাসের মধ্যে বেশিরভাগ রিপোর্ট আসার পর সেগুলো নিয়ে তার কাছে যাই। রিপোর্ট দেখে তিনি বলেন, “সব রিপোর্ট নরমাল। ভেবেছিলাম আপনার এমডিআর বা সারকোডোসিস। কিন্তু রিপোর্টে কিছু না আসায় এখন আমি আপনাকে নিয়ে চিন্তিত।” এই বলে তিনি এবার কোর বায়োপসি করাতে বলেন। একপর্যায়ে আমাকে প্রশ্ন করেন, “আপনাকে টিবির ওষুধ দিয়েছিলো কে?” তখন আমি বললাম, আপনি দিয়েছেন। আমার জবাব শুনে তিনি নিশ্চুপ হয়ে যান।’

কোনও রোগ ধরা না পড়ায় আলী হোসেন এবার ইব্রাহীম রনিকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনাকে যক্ষ্মার ওষুধ দিয়েছিল কে? এটা তো যক্ষ্মা নয়।

ইব্রাহীম রনি বলেন, ‘এত বড় একজন চিকিৎসক যখন এমন কথাগুলো বলছিলেন, তখন আমার চোখে পানি চলে এসেছিল। এ অবস্থায় অসহায় হয়ে স্ত্রীকে নিয়ে তার চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসি।’

রনি বলেন, ‘আলী হোসেন অনেক সিনিয়র ও অভিজ্ঞ একজন চিকিৎসক বলে জানতাম। অথচ সবকিছু পর্যালোচনায় বুঝলাম, তিনি যে আমাকে টিবির চিকিৎসা দিয়েছিলেন, তা ছিল ভুল। কারণ, আগে এবং পরে যতগুলো টেস্ট করিয়েছি, কোথাও টিবি ধরা পড়েনি। তার এমন ভুলে আমার জীবন প্রায় শেষ। সময় গেলো, অনেকগুলো টাকা খরচ হলো। অথচ আমি এখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছি।’

এ ব্যাপারে জানতে ল্যাবএইড হাসপাতালে ডা. আলী হোসেনের চেম্বারের টেলিফোন নম্বরে ফোন দিলে জানানো হয়, ‘স্যার নেই। কোথায় গেছেন, তা বলতে পারেন না কেউ।’

সাংবাদিক ইব্রাহীম রনি

শনিবার (০৮ জুলাই) সন্ধ্যায় ডা. আলী হোসেনের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেননি তিনি। তবে ল্যাবএইড হাসপাতালের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আগামীকাল রবিবার ওই চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি জানাবেন তারা। 

রনির চিকিৎসার বিষয়ে একাধিক চিকিৎসক জানিয়েছেন, রোগীর সিমটম দেখে যক্ষ্মার ওষুধ দেন অনেক চিকিৎসক। কিন্তু এটা ঠিক নয়। আরও ছয় মাসের কোর্স দেওয়া মানে পূর্ণ ওষুধ। এমন ভুল চিকিৎসা দেওয়া উচিত হয়নি।

বর্তমানে গুরুতর অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি রয়েছেন রনি

চাঁদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক (মেডিসিন) ডা. সালেহ আহমেদ প্রায় তিন দশকের বেশি সময় ধরে চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালসহ বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে সিনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে চিকিৎসা দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘যক্ষ্মা রোগ তো বটেই, আরও যেসব জটিল রোগ আছে, সেগুলোর ধরন দেখে একজন চিকিৎসক চিকিৎসা দিতে পারেন। কিন্তু সেটি রোগ নির্ণয়ের আগ পর্যন্ত সাময়িক কয়েকটা দিন হতে পারে, কখনও পরীক্ষা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ দিতে পারেন না। এখানে যে চিকিৎসকের কথা বলা হচ্ছে, তিনি এই ধরনের বড় ভুল করবেন; আবার বলবেন ভুল হয়েছে—তা হতে পারে না। তার মতো চিকিৎসকের কাছে এমন ভুল আশা করা যায় না।’

যক্ষ্মার চিকিৎসার বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ প্রোগ্রামের কর্মকর্তা এমবিডিসি-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর ডা. আফজালুর রহমান বলেন, ‘যক্ষ্মা নির্ণয়ের জন্য কফের মাইক্রোস্কোপিক টেস্ট, জিন এক্সপার্ট টেস্ট করা হয়। চিকিৎসক প্রয়োজন মনে করলে এক্স-রেসহ আরও কিছু পরীক্ষা করাতে পারেন। ওই রোগীর জন্য কী কী প্রযোজ্য হতে পারে—এটি চিকিৎসক নির্ধারণ করবেন।’

যক্ষ্মা পজিটিভ না হওয়া সত্ত্বেও চিকিৎসক এমন চিকিৎসা দিতে পারেন কিনা জানতে চাইলে আফজালুর রহমান বলেন, ‘এটি ওই চিকিৎসক বিচার-বিবেচনা করবেন। জীবাণু না পেলেও যদি ক্লিনিক্যালি অন্যান্য বিচার-বিশ্লেষণে তার মনে হয়, যক্ষ্মার চিকিৎসা শুরু করতে পারেন। তবে রোগী সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনে এক্ষেত্রে এই জাতীয় মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন

তিনি বলেন, ‘সাড়ে পাঁচ মাস ওষুধ সেবনের পরও রোগীর উন্নতি না হলে সেক্ষেত্রে ভুল চিকিৎসা হতে পারে। কারও যদি চিকিৎসকের ওপর আস্থা না থাকে, সেক্ষেত্রে অন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন। অনেক রোগীর সহজেই স্পুটাম টেস্টে রোগ ধরা পড়ে। আবার কোনও কঠিন রোগীর ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার জন্য নানা ধরনের ইনভেস্টিগেশন করাতে পারেন চিকিৎসক। একজন চিকিৎসক ভালো বলতে পারেন, তার কাছে আসা রোগীকে কীভাবে ট্রিটমেন্ট করাবেন।’

এদিকে, ভুল চিকিৎসায় সাংবাদিক রনির এমন করুণ অবস্থার বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না চাঁদপুরের সাংবাদিকরা। চাঁদপুর প্রেসক্লাবসহ সাংবাদিক সংগঠনগুলো ক্ষুব্ধ ও নিন্দা জানিয়েছেন। আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছেন তার সহকর্মীরা।