‘উনি LGBTQ-দের ঘৃণা করেন’, অধ্যাপিকার বিরুদ্ধে পড়ুয়াদের একাংশের অভিযোগ! উত্তপ্ত সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়

‘উনি এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের নামে কুরুচিকর মন্তব্য করেছেন। বলেছেন, ওঁরা ‘ব্যারেন’ (বন্ধ্যা)। সন্তান উৎপাদনে অক্ষম। পরিবারের ভাঙের মূলে।’

‘আমি বলেছিলাম, কার্ল মার্ক্স পরিবারিক কাঠামোই বিশ্বাস করতেন। এই কথায় এক ছাত্রী ক্ষেপে গিয়ে বলে, আমি ভুল বলছি। তার পরে আমায় অপমান করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যায়।’

 

এই রকম দু’টি অভিযোগ নিয়ে এই মুহূর্তে বেশ উত্তেজনা সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। প্রথম অভিযোগটি এক পড়ুয়ার। যাঁর বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগটি করা হয়েছে, দ্বিতীয়টি অভিযোগটি সেই অধ্যাপিকার। মৌসুমী সেন ভট্টাচার্যর।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া এবং অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের সঙ্গে কথা বলে হিন্দুস্তান টাইমস এখনও পর্যন্ত যা জানতে পেরেছে, তাতে ঘটনাটি কিছুটা এমন:

চলতি মাসের ১৯ তারিখ অধ্যাপিকা মৌসুমী সেন ভট্টাচার্য ইংরেজি বিভাগের স্নাতকোত্তরের স্তরের ক্লাস নিতে যান। তাঁর বিরুদ্ধে কয়েক জন পড়ুয়ার অভিযোগ, তিনি সেখানে এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের মানুষের সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করেন। তিনি নাকি প্লেটো সম্পর্কিত ক্লাস নিতে এসে কার্ল মার্ক্সের তত্ত্ব নিয়ে পড়াতে শুরু করেন। এবং সেই সূত্রে পরিবার, পারিবারিক কাঠামোর প্রসঙ্গে ঢোকেন। তার পরেই তিনি নাকি বলেন, এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের মানুষ পরিবার ভাঙনের কারণ। এই সম্প্রদায়ের সব মানুষের সম্পর্কে ‘বিকারগ্রস্ত’, ‘বন্ধ্যা (ব্যারেন)’ এবং ‘ত্রুটিপূর্ণ (ডিফেকটিভ)’-এর মতো শব্দ ব্যবহার করেন তিনি। এর পরে এক পড়ুয়ার মানসিক সমস্যা হয়। তিনি ক্লাসরুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হন বলেও দাবি করেছেন কয়েক জন পড়ুয়া। ঘটনার ৭ দিন পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক জন পড়ুয়া বিক্ষোভ দেখান। মোটের উপর এই হল পরিস্থিতি।

অভিযোগ যখন আছে, পালটা অভিযোগও থাকবে। কোন পক্ষ কী বলছেন, তা জানার জন্য ফোন করা হয়েছিল হিন্দুস্তান টাইমসের তরফে।

অভিযোগকারী ছাত্রী ফেসবুকের পোস্টের স্ক্রিনশট।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পড়ুয়া জানান, ‘কিছু দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাইড মান্থ উপলক্ষে ‘গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি’ সিনেমাটি দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মৌসুমী সেন ভট্টাচার্য সেটি দেখতে আসেননি। সমকামী-সহ এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের প্রতি ওঁর ঘৃণা আছে। সেখান থেকেই উনি সুযোগ পেলে এই ধরনের কথা বলেন। সেদিন ক্লাসেও এমনই ঘটেছে। উনি মার্ক্সের সূত্র ধরে বিষমকামী পারিবারিক কাঠামোর আলোচনায় ঢুকে পড়েন। আর এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের মানুষ সেখানে বেমানান এমন কথা বলতে থাকেন। তাঁরা সন্তান উৎপাদনে অক্ষম বলেও মন্তব্য করেন।’

এই অভিযোগ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হয় মৌসুমী সেন ভট্টাচার্যর সঙ্গেও। তিনি গোড়াতেই তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া যাবতীয় অভিযোগ উড়িয়ে দেন। বলেন, ‘প্লেটো নিয়েই ক্লাস ছিল। ‘রিপাবলিক’ পড়ানোর সূত্রেই পরিবারের কথা আসে। আর সেই সূত্রেই কার্ল মার্ক্স। আমি বলেছিলাম, মার্ক্স পারিবারিক কাঠামোয় বিশ্বাসী ছিলেন।’ অধ্যাপিকার দাবি, এর পরেই এক ছাত্রী উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। তিনি নাকি উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আপনি ভুল বলছেন’। এবং এর পরে নাকি তিনি রেগে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। ‘ব্যাগটাও পড়ে থাকে। সেটিও নিতে আসে না ছাত্রীটি’, এমনই দাবি অধ্যাপিকার।

ক্লাস থেকে ছাত্রীর বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে দু’ধরনের মত দুই পক্ষের। ছাত্রী এবং তাঁর সহপাঠী ও বন্ধুদের মত, অধ্যাপিকার এই মন্তব্যের কারণে ছাত্রী মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক পড়ুয়ার বক্তব্য, ‘যাঁরা নিজেরা এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত, তাঁদের অনেকেরই ভয়ঙ্কর অতীত থাকে। বড় হওয়ার পরেও সেই সব ঘটনার রেশ মনের মধ্যে থেকে যেতে পারে। আর তার মধ্যে এমন ধরনের কথা শুনলে প্যানিক অ্যাটাক হওয়া খুব স্বাভাবিক। সেদিন ক্লাসেও একই ঘটনা ঘটে। অধ্যাপিকার কথা শুনে আমাদের বন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়ে।’ যদিও মৌসুমী সেন ভট্টাচার্য নিজে এই কথা মানতে রাজি নন। তাঁর বক্তব্য, ‘অভব্য ভাবেই ছাত্রীটি ক্লাস থেকে বেরিয়ে যায়। ওর সহপাঠীরাই তখন আমায় বলে, যেহেতু ও নিজে এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের সদস্য, তাই বিষয়টি ও খোলা মনে নিতে পারেনি। সে কারণেই এমন আচরণ।’ পাশাপাশি তাঁর দাবি, ‘আমি তৃতীয় লিঙ্গকে ঘৃণা করব কেন? আমি নিজে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। খোলা পরিবেশেই পড়াশোনা করেছি। আমি কুইয়ার থিয়োরি ভালো না জানতে পারি, কিন্তু কারও বিরুদ্ধেই কোনও ঘৃণা নেই।’

এই ঘটনার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক জন পড়ুয়া ভিসি-র কাছে লিখিত অভিযোগ জানেন এবং বিষয়টিকে ‘Internal Complaints Committee’ বাICC-র কাছে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেন। এর পরে ২৬ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরা বিক্ষোভ দেখাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। মৌসুমী দেবীর অভিযোগ, বিক্ষোভরত পড়ুয়াদের মধ্যে একজন তাঁকে সিঁড়িতে ধাক্কা দেন। তিনি সামলে নেন। কিন্তু সামান্য অসাবধানতায় তিনি পড়েও যেতে পারতেন। যদিও বিক্ষোভকারী পড়ুয়াদের একজনের দাবি, ধাক্কা দেওয়ার প্রশ্নই উঠছে না। তাঁরা অধ্যাপিকার কাছাকাছির মধ্যে যাননি। তাঁর পিছন পিছন স্লোগান দিতে দিতে তাঁরা এগোন। সেটিও দূরত্ব বজায় রেখে। এবং অন্য শিক্ষক-শিক্ষিকারাও এই ঘটনার সাক্ষী বলেও দাবি করেছেন তাঁরা।

আপাতত পরিস্থিতি বেশ থমথমে। এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান জানতে চেয়ে ভিসি রাজকুমার কোঠারির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় হিন্দুস্তান টাইমসের তরফে। প্রথম বার তাঁকে ফোনে পাওয়া গেলেও, তিনি জানান, ব্যস্ত আছেন। ঘণ্টাখানেক বাদে ফোন করতে বলেন। যদিও এর পরে তাঁকে আর ফোনে পাওয়া যায়নি।

বিষয়টি আপাতত ‘Internal Complaints Committee’-র বিচারাধীন বলে শোনা গিয়েছে। সেই বিচারের অপেক্ষা করা যেতেই পারত। কিন্তু শুক্রবার বিকেলের একটি ঘটনা, এই পরিস্থিতিকে কিছুটা উত্তপ্ত করেছে। ঘটনার প্রথম দিন থেকে কয়েক জন পড়ুয়ার তরফে ‘প্যানিক অ্যাটাক’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকী অভিযোগকারী পড়ুয়া সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেছেন, অধ্যাপিকার কথা শুনে তাঁর ‘প্যানিক অ্যাটাক’ হয়। ঘটনাচক্রে শুক্রবার সোশ্যাল মিডিয়ায় মৌসুমী সেন ভট্টাচার্য এই ‘প্যানিক অ্যাটাক’ নিয়েই একটি পোস্ট করেন। তাঁর লেখার বাংলা অনুবাদ করলে বিষয়টি কিছুটা এরকম দাঁড়াবে, ‘প্যানিক অ্যাটাক একটি সিরিয়াস ক্লিনিক্যাল অসুখ। বিষয়টি নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। মনোচিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। এবং নিয়মিত মনোবিদের পরামর্শ নেওয়া উচিত।’ এর পরে তিনি লেখেন সচেতন নাগরিক হিসাবে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে এই পোস্ট। যদিও পড়ুয়াদের এক জনের বক্তব্য, ‘অভিযোগকারী ছাত্রীটিকে অপমান করার জন্যই ভর্ৎসনা করে এই পোস্ট। মজার কথা, উনি যখন এই পোস্টটি করছেন, আমাদের সহপাঠী সেই মুহূর্তে সত্যিই বেহাল মানসিক অবস্থা নিয়ে মনোবিদের সামনে বসে।’

<p>অধ্যাপিকা মৌসুমী সেন ভট্টাচার্যের পোস্ট</p>

অধ্যাপিকা মৌসুমী সেন ভট্টাচার্যের পোস্ট

মৌসুমী দেবীকে এই বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে, তিনি বলেন, তাঁর এই পোস্টের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার কোনও সম্পর্ক নেই। এক বন্ধু তাঁর কাছে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন বলে তিনি ওই পোস্টটি করেন। নিজের কোনও ছাত্রছাত্রী ফেসবুক মারফত তাঁর সঙ্গে যুক্ত নন। ফলে এটি কাউকে দেখানোর উদ্দেশ্য তাঁর নেই।

দু’পক্ষের অভিযোগ এবং পালটা অভিযোগে এই মুহূর্তে ডামাডোল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। পড়ুয়াদের একাংশ হেস্তনেস্ত চান, আর অধ্যাপিকাও নিজের মতে অটল। আপাতত তাই আইসিসি-র সিদ্ধান্তের অপেক্ষা।