চালনা গিয়েও স্বাস্থ্যসেবা পান না গৌরম্ভার জেলেরা!

ওই যে বাঁধের পরেই পশুর নদী দেখছেন। এই নদীর ওপারেই চালনা। আমরা এপারের মানুষ রামপালের গৌরম্ভায় বাস করি। জরুরি প্রয়োজনে গর্ভবতী নারীদের নিয়ে ওপারে গেলেও স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয় না। সেবা নিতে হলে মিথ্যা বলতে হয়। ওপারের পরিচিত কারও বাড়ির ঠিকানা দিয়ে সেবা নিতে হয়। আমাদের জেলে পল্লীর যে পরিবেশ তাতে ছোট-বড় সকলেরই ডায়রিয়া, এলার্জি, চুলকানি, ঘা পাঁচড়া লেগেই থাকে। প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন। আট জন গর্ভবতীর নিয়মিত চেকআপ দরকার। পুষ্টি বিষয়ে সেবা দরকার। কিন্তু ওপারে কোনও সেবা সহজেই পাওয়া যায় না। আর রামপাল অনেক দূর। এ চর থেকে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় সেখানে যাওয়ার চিন্তাও করা যায় না।

গৌরম্ভা ইউনিয়নের কৈবদ্দাসকাঠি চরের জেলে পরিবারের সদস্য তানিয়া বেগম স্বাস্থ্যসেবার পরিস্থিতি নিয়ে এভাবেই বললেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমি নিজেও টিকা গ্রহণসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা নিতে যাই। আমার ঠিকানা শুনে প্রথম সেবা দিতে চায়নি। আমাকে ফেরত পাঠায়। পরে চালনার ঠিকানা দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা কার্ডটি নেই। এখনও ওই কার্ডই স্বাস্থ্যসেবা নিতে হয়।’

শুধু তানিয়াই নন। এ চরে বসবাসকারী ৮০০ পরিবারে একই অবস্থা। বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার প্রত্যন্ত ইউনিয়ন গৌরম্ভা। এ ইউনিয়নের কাপাসডাঙ্গা গ্রামের অবহেলিত জনপদ কৈগদ্দাসকাঠি চর। যা পশুর নদীর চর। এ চরটি বাগেরহাটের রামপাল ও খুলনার দাকোপ উপজেলার সীমান্তে। এ চরে বসবাস করেন ৮০০ জেলে পরিবার।

তানিয়া বলেন, ‘আমার ফুফু শাশুড়ি রহিমা বেগম (৪০) সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় চিকিৎসা না পেয়ে ছয় বছর আগে রক্তক্ষরণে মারা যান। তখন তাকে নিয়ে এই নদী পার হয়ে চালনা হাসপাতালে যাই। কিন্তু ঠিকানা শোনার পর সেবা না দিয়ে খুলনা মেডিক্যালে পাঠিয়ে দেন। সেখানে নিতে নিতে পথেই তিনি মারা যান।’ তিনি বলেন, ‘এখন এ চরে আট জন গর্ভবতী রয়েছেন। প্রত্যেকেই অপুষ্টির শিকার। এ সব মায়েরা জন্মও দিচ্ছেন অপুষ্ট শিশু। সবারতো ওপারে পরিচিত জন নেই। তাই স্বাস্থ্যসেবা পান না অনেকে।’

এ প্রতিবেদক সরেজমিন কৈবদ্দাসকাঠি চর পরিদর্শনের সময় দেখতে পান, সরকারে তৈরি করে দেওয়া চার সারির ঘরগুলোর সামনে হাঁটু পানি জমে আছে। টয়লেটের ট্যাংকিগুলোও পানিতে নিমজ্জিত। পানিতে হাঁটলে যতটুকু ভেজে ততটুকুকে চুলকাতে থাকে। চরজুড়ে বালুর স্তূপ। বালু দিয়ে ভরাট করার সময় সেপটিক ট্যাংকও বালু ভরাট হয়ে গেছে। ফলে সেগুলো অকেজো। তাই টয়লেট করার পর তা পানির চাপে ঘরেই ভেসে থাকে। কাঁচা রাস্তায় চলাচল করতে হয় জমে থাকা পানির ওপর দিয়েই। এতগুলো পরিবারের জন্য রয়েছে একটি মাত্র গভীর নলকূপ। তাও আসা যাওয়ায় এক ঘণ্টা সময় লাগে।

আই আর ভি নির্বাহী পরিচালক মেরিনা যুথি বলেন, ‘কৈবদ্দাসকাঠি চরে স্থানীয় কোনও কমিউনিটি ক্লিনিক নেই। স্বাস্থ্যসেবার জন্য রামপাল যেতে হয়। যা অনেক দূরে। কাছে অন্য উপজেলা চালনা যেতে হয় পশুর নদী পার হয়ে। সেখানে গেলে অনেক সময় সেবা মেলে না। বেসরকারি পর্যায়েও তেমন কোনও সেবা প্রদানের উদ্যোগ নাই। এদের জন্য ওই এলাকায় কমিউনিটি ক্লিনিকের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।’

গৌরম্ভা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাজিব সরদার বলেন, ‘চরের অসহায় মানুষের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ওইখানেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপনের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বাস্তবায়নের জন্য অপেক্ষা। আর স্বাস্থ্যসেবা পেতে ঠিকানা জরুরি কেন হবে। এটা জানা ছিল না। খোঁজ খবর নিয়ে দেখবো কি করা যায়।’

দাকোপের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সুদীপ বালা বলেন, ‘অন্য উপজেলার ঠিকানা হওয়ায় স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয় না, এ ধরণের অভিযোগ সঠিক নয়। এখন কোনও জটিল রোগীকে খুলনা রেফার করা হলে তাকে সেবা না দেওয়া ভাবলে চলবে না। আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী সেবা প্রদান করা হয়। এ হাসপাতালে দাকোপ, পাইকগাছা, মোংলাসহ বিভিন্ন উপজেলার রোগী ভর্তি রয়েছে।’

খুলনার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. শেখ কামাল হোসেন বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবা খতিয়ান দেখে হয় না। রোগ বুঝে সেবা দেওয়া হয়। এলাকাভিত্তিক অভিযোগের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট হলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারবো।’