খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলে রেকর্ড

নিয়মনীতির শিথিলতার সুযোগ নিয়ে গত বছর ব্যাংকিং খাতে রেকর্ড পরিমাণ খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল (রি-শিডিউল) বা নবায়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মূলত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি কমাতে অনেক সময় এই সুযোগ দিয়ে থাকে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত এক বছর (২০২২ সালে) ব্যাংকিং খাতে রেকর্ড পরিমাণ ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে।

রবিবার (১৩ আগস্ট) বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিশেষ ছাড়ের আওতায় ২৬ হাজার ৮১০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছিল। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে আড়াই গুণের বেশি খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে।

২০২০ সালে ১৯ হাজার ৮১০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হলেও, তার আগের বছর ২০১৯ সালে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছিল ৫২ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, রেকর্ড পরিমাণ খেলাপি ঋণ নবায়নের পরও ব্যাংক খাতে (২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত) খেলাপি ঋণ বেড়ে ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অবশ্য চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত তা আরও বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে রাইট অফ করা ঋণ খেলাপি ঋণের সঙ্গে যোগ করলে মোট খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যাবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিশেষ ছাড়ের আওতায় নবায়ন করা ঋণের একটি অংশ পুনরায় খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। গত বছর নবায়ন করা পুনরায় খেলাপি হওয়ার স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা। নবায়নের শর্ত অনুযায়ী কিস্তি পরিশোধ না করায় সেগুলো পুনরায় খেলাপি হয়েছে। ২০২১ সালে এমন ঋণের স্থিতি ছিল ৩২ হাজার ৯৬০ কোটি, ২০২০ সালে ২৯ হাজার ৯৩০ কোটি এবং ২০১৯ সালে ছিল ২৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। 

আইএমএফের শর্ত ছিল, বছরে কী পরিমাণ খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়, এর তথ্য প্রকাশ করতে হবে। সেই শর্তের আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই প্রথমবারের মতো এসব তথ্য প্রকাশ করলো। একই সঙ্গে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার শর্ত দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থাটি।

২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পুনঃতফসিলের নীতিমালা শিথিল করে। নীতিমালায় ছিল ঋণ থেকে দায়মুক্তির এককালীন ব্যবস্থা। এই সুবিধার আওতায় ঋণগ্রহীতারা বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার চেয়ে কম পরিমাণ অর্থ এককালীন পরিশোধ করে তাদের খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারতেন।

এই উদ্যোগের ফলে পুনঃতফসিল করা ঋণ বেড়ে যায়। ২০১৯ সালে মোট ৫২ হাজার ৭৭০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়, যা একটি রেকর্ড। এই রেকর্ড ভেঙে ২০২২ সালে ব্যাংকিং খাতে নতুন রেকর্ড ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নবায়ন করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে খেলাপি ঋণের চেয়েও বেশি। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ে নবায়ন করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। ২০২১ সালে এই ঋণের স্থিতি ছিল ১ লাখ ৬৮ হাজার ৪১০ কোটি, ২০২০ সালে ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৬৩০ কোটি এবং ২০১৯ সালে ছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার ২৪০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, খেলাপি ঋণ নবায়নের স্থিতি বেড়ে যাচ্ছে। চার বছরের ব্যবধানে নবায়নের স্থিতি বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। অর্থাৎ বিশেষ ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণকে নিয়মিত করে রাখা হচ্ছে। নবায়ন করা ঋণের মধ্যে নিয়মিত থাকা ঋণের স্থিতি খুব বেশি বাড়ছে না। ২০১৯ সালে নবায়ন করা ঋণের মধ্যে নিয়মিত ঋণের স্থিতি ছিল ১ লাখ ৬ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে তা বেড়ে ১ লাখ ২৫ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা হয়েছে। ২০২১ সালে তা আরও বেড়ে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৪৩০ কোটি এবং ২০১৯ সালে তা আরও বেড়ে ১ লাখ ৭১ হাজার ৯২০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, গত বছর আদায় অযোগ্য ঋণই রয়েছে ৮৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ২০২১ সালে ছিল ৮৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ নবায়নের মধ্যেও আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের ৪৬ শতাংশই রয়েছে শীর্ষ ৫ ব্যাংকে। যার পরিমাণ ৫৫ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। আর অন্যান্য ব্যাংকে আছে ৫৪ শতাংশ, যার পরিমাণ ৬৫ হাজার ১৯০ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে শীর্ষ ১০ ব্যাংকেই ৭৮ হাজার ১৩০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে, অর্থাৎ ১০ ব্যাংকেই রয়েছে ৬৪ দশমিক ৮ শতাংশ খেলাপি ঋণ। অন্যান্য ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ৪২ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা বা ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ।

একইভাবে মোট আমানতের মধ্যে শীর্ষ ১০ ব্যাংকের কাছে রয়েছে ৪৬ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্য সব ব্যাংকে রয়েছে ৫৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এ ছাড়া মোট সম্পদের ১০ ব্যাংকে রয়েছে ৪৪ দশমিক ৬ শতাংশ।

এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বলেন, ‘পুনঃতফসিল ব্যাংকিং খাতের একটি নিয়ম হলেও, এটি ভালো কাজের জন্য ব্যবহার হচ্ছে না। পুনঃতফসিলের পরও ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়ার প্রবণতা ব্যাংকিং খাতের জন্য অশনি সংকেত। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের মধ্যে এই সুবিধার অপব্যবহার করার প্রবণতা দেখা যায়।’