দুরন্ত শৈশব মনে করিয়ে দেয়া এক ছবি

আমাদের শৈশব স্মরণ করিয়ে দেয়া এক ছবির নাম ‘আম কাঁঠালের ছুটি’! পরিচিত ঘরানার বাইরে অনেকটা ‘আউট অব দ্য বক্স’ ছবি ‘আম কাঁঠালের ছুটি’। নাচ, গান বা মেলোড্রামার অনেক বাইরে নাগরিক আর গ্রামীণ জীবনের এক ‘শৈশব বান্ধব’ ছবি ‘আম কাঁঠালের ছুটি’। রস-কস বুলবুলি, জোলা ভাতি কিংবা লাটিম খেলা, গাছে চড়া, নদী বা তালগাছ নিয়ে অতিপ্রাকৃত ধারণা, বুকঝিম করা ঘুঘুর ডাক আর ‘বল্লা রাশি’র এক ছবি ‘আম কাঁঠালের ছুটি’!

যা দেখে ‘ডিজিটাল’ যুগের শিশু কিশোররা ভাবতে পারে এমনও কি জীবন হয়? শহুরে ছেলে শুভ। সে ঘরবন্দী। গ্রীষ্মের ছুটিতে যায় দাদীর সাথে গ্রামে। এই ছবির দুরন্ত মুইন্না যে গ্রামটাকে খুব ভালোভাবে চেনে কিন্তু বইয়ের পাঠে আদৌ মনোযোগী নয়, ঘরে সে থাকতে চায় না। গ্রামের নদী, জংলা, গাছ আর পাখিতেই ভালো লাগা তার। মনোয়ার তার আসল নাম, মুইন্না ডাকলে সে মন খারাপ করে। ক্লাসের পড়া ফেলে সে আঙুল লুকানো খেলা খেলে। সাতচল্লিশ আর তিন কত হয়- শিক্ষকের সামনে আঙুল গুনে সে এই প্রশ্নের উত্তর বের করতে পারে না। ফলাফল পিঠের ওপর ধমাধম। তার আগে শিক্ষক ছড়া কাটেন, ‘মুইন্না কিল দিমু গুইন্যা!’ স্কুল শেষে মুইন্যার সহপাঠিরা এই ছড়া কাটতে কাটতে তার পেছনে হাঁটে, মুইন্না একজনকে শাসনও করে। বাসার দরোজায় সে নামটা শুদ্ধ করে লিখতে চায়। সে নিজের ও তার ভাইয়ের নাম লিখলেও মুইন্নাকে কেউ মনোয়ার বলে না। ব্যতিক্রম শুভ। সে শহর থেকে সামার ভ্যাকেশানে গ্রামে এসে মনোয়ারকে ভাই বলে ডাকে। মুইন্নাকে তার মা বাসায় আটকে রাখে। বাসা থেকে বের করে আনতে মুইন্নার ভাই আনোয়ার ওরফে আনাইর‌্যা শুভর সাহায্য নেয় যাকে সে লাটিম খেলা শিখিয়েছিল। শুভ এসে তাদের মাকে বললে মুইন্যাকে তাদের সাথে যেতে দেয়া হয়।

গ্রাম ঘুরতে বেরিয়ে মুইন্যা নেতৃত্ব নিজের হাতে তুলে নেয়। তার একটাই সমস্যা। সে বল্লা রাশি, তাকে শুধু বল্লা কামড় দেয়। সে তালগাছের নীচে এসে ভরদুপুরে এখানে আসতে মানা করে শুভকে। নদীর কাছে এসে বলে এখানে শেকল আছে। এক মায়ের একপুতকে এই শেকল টেনে নিয়ে যায়! এরপর জোলা ভাতি খেলায় মাতে। চুলা আর পাতিল আনা হয় বাবা মার চোখের আড়ালে। ভাত আর সবজি রান্না হয়। কিন্তু মুইন্যাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাকে কী বল্লা নিয়ে গেল কিংবা শেকলওয়ালা নদী?

ছবির কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালে। প্রথম বছর চিত্রায়ণ করা অনেক কিছু কাজে লাগানো যায়নি। ২০১৬-১৭ সালে ছবির শুটিং শেষ হয় কিন্তু ৯৭ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই ছবি মুক্তি পায় ছয় বছর পর ২০২৩ এর ১৮ আগস্ট। ছবির গল্প লিখেছেন শরীফ উদ্দিন সবুজ এবং প্রধান সহকারী পরিচালক ছিলেন ‘আদিম’ খ্যাত যুবরাজ শামীম। ছবির সিনেমাটোগ্রাফি, চিত্রনাট্য তৈরি, পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছেন মোহাম্মাদ নুরুজ্জামান। ছবিটি রাশিয়ার ১৬তম চেবকসারি ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালের স্পেশাল জুরি আ্যাওয়ার্ড এবং রাশিয়ার উল্লিয়ানাভাস্ক ফিল্ম ফেস্টিভালে বেস্ট সিনেমাটোগ্রাফারের অ্যাওয়ার্ড জেতে।

২০১৫-১৭ সালে শুটিংয়ের সময়কার শিশুরা এখন হয়তো কৈশোরে পা দিয়েছেন। একজন ছাড়া ছবির অভিনেতা অভিনেত্রীরা আগে কখনও অভিনয় করেননি। দুরন্ত মুইন্যার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন লিয়ন এবং শুভ চরিত্রে অভিনয় করেছেন জুবায়ের। আনোয়ার বা আনাইর‌্যা চরিত্রে আরিফ, মিতা চরিত্রে তানজীল, রিতা চরিত্রে হালিমা এবং মুইন্যার মা চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফাতেমা। ফাতেমা এর আগে যুবরাজ শামীমের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিতে অভিনয় করেছিলেন।

ফড়িং ধরে সুতো দিয়ে বাঁধা, টেবিলে দুজনের হাত রেখে হাত দিয়ে হাতে মারার  খেলা, গুলতি দিয়ে আম পাড়া, মৌচাকে ঢিল ছুঁড়ে বল্লার কামড় খাওয়া, তাল গাছের নীচে ছায়া মাপা, লাটিম খেলা, ইট দিয়ে উইকেট বানিয়ে ক্রিকেট খেলা, গাছে ওঠা, গাছে বিছানার মতো বানিয়ে সেখানে লুকিয়ে ঘুমিয়ে থাকা, সবজি চুরি করে পাতার টাকায় দাম পরিশোধ করা, মৌমাছির ভনভন, ঘুঘুর ডাক, বল্লার কামড় থেকে বাঁচতে নদীতে ডুব দেয়া; এমন অনেক কিছুই আছে ছবিতে। কয়েকটা দৃশ্য সামান্য বড় মনে হলেও অভিনয়ের জায়গাটা খুবই স্বাভাবিক এবং সুন্দর। সাদা কালো টোন বা প্যালেটে শুট করা ছবিটা ফেলে আসা দিনের ভাবনায় করা হলেও হয়তো স্মৃতিতে এটাই রঙিন। শিশু কিশোর এমনকি বড়দের জন্যও এই ছবি হতে পারে মাইলফলক। ছবির সিনেমাটোগ্রাফার এবং পরিচালক মোহাম্মাদ নুরুজ্জামানকে ধন্যবাদ জানানো যেতে পারে।

আহসান কবির এমনিতেই মধ্যবিত্ত বাঙালির একটা কালচার ছিল স্কুলের ছুটিতে গ্রামে বেড়াতে যাওয়া। অনেক কবি সাহিত্যিকের লেখায় এমন ‘অ্যাডভেঞ্চার’ আছে, হোক সেটা সত্যজিতের ‘ফেলুদা’ কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কাকাবাবু’। ছবিতে আবার তেমন নির্দিষ্ট কোনও গল্প হয়তো নেই, আছে গ্রামে দুরন্তপনার কিছু পরিস্থিতির চিত্রায়ন যেটা শৈশবকে গেঁথে রাখে! জীবনের সবচেয়ে রঙিন এই সময়টাকে চিত্রায়ণ করা হয়েছে সাদা কালো প্যালেটে, কোনও গান বা প্রায় আবহ সংগীত ছাড়া। পরিস্থিতি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে বাস্তব শব্দই ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। ছবির শুটিং হয়েছে গাজীপুরের হারবাইদ গ্রামে। এই ছবিতে ব্যবহৃত হয়েছে কিছু প্রচলিত ছড়াও। যেমন-

ওয়ান টু থ্রি/ সাবে খায় বিড়ি/ বিড়িতে নাই আগুন/ পাইলাম একটা বাগুন/ বাগুনে নাই বিচি/ পাইলাম একটা কেচি/ কেচিতে নাই ধার/ পাইলাম একটা হার/ হারে নাই লকেট/ পাইলাম একটা পকেট/ পকেটে নাই টাকা/ কেমনে যামু ঢাকা?/ ঢাকায় নাই গাড়ি/ ফিরে আইলাম বাড়ি/ বাড়িতে নাই কাম/ গাছে পাকে আম/ আম কাঁঠালের গন্ধ/ হাই স্কুল বন্ধ…।

নির্মাতা মোহাম্মদ নূরুজ্জামান আম কাঁঠালের ছুটি: রেটিং ৭/১০

মুক্তি: ১৮ আগস্ট

ধরন: কিশোর অ্যাডভেঞ্চার

দৈর্ঘ্য: ৯৭ মিনিট

গল্প: শরীফ উদ্দিন সবুজ

প্রযোজনা, পরিচালনা, চিত্রনাট্য ও সাউন্ড ডিজাইন: মোহাম্মদ নূরুজ্জামান

সিনেমাটোগ্রাফি: মোহাম্মদ নূরুজ্জামান ও ম্যাক সাব্বির

প্রধান সহকারী পরিচালক: যুবরাজ শামীম

অভিনয়ে: লিয়ন, জুবায়ের, আরিফ, হালিমা, তানজিল, ফাতেমা, কামরুজ্জামান, কামরুল, আবদুল হামিদ প্রমুখ

সমালোচক: রম্যলেখক, সাংবাদিক ও কবি

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

আরও সমালোচনা:

প্রিয়তমা: পরিচিত গল্প আর ‘তাড়াহুড়ো’য় নির্মিত ছবি!

প্রহেলিকা: ছবিটি দেখলে কিছু প্রশ্ন উঠবেই

‘পরাণ’-এর আরেক ভার্সন ‘সুড়ঙ্গ’!

সুলতানপুর: ফর্মুলায় আক্রান্ত ধারাবাহিকতাহীন ছবি

আদিম: ‘বস্তি ঘনিষ্ঠ’ এক অপরূপ ছবি!

পাপ: শেষ না হওয়া এক থ্রিলার গল্পের ছবি

কিল হিম: বড়শি দিয়ে মাছ ধরেন অনন্ত, কিন্তু সেটা নড়ে না!

লিডার: স্বস্তি আর অস্বস্তির পাঁচ-ছয়

লোকাল: রাজনীতির ব্যানারে প্রেম ও প্রতিশোধের ছবি!

জ্বীন: ‘জিন ছাড়ানো’র কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছবি!