স্কোপোলামিন দিয়ে সর্বস্ব লুট করছে তারা

সর্বস্ব লুটে নিতে অভিনব পদ্ধতি ব্যবহার করছে একটি বিদেশি চক্র। এই চক্রের বেশিরভাগ সদস্যই ইরানি নাগরিক। বিভিন্ন দেশ হয়ে ঢাকায় প্রবেশের পর অভিনব পদ্ধতিতে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে বেড়াচ্ছে তারা। ‘স্কোপোলামিন’ নামে একধরনের মাদক দিয়ে স্বর্বস্ব হাতিয়ে নেয় তারা। সম্প্রতি এই চক্রের একাধিক সদস্যের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। গ্রেফতার করা হয়েছে একাধিক সদস্যকে।

পুলিশ বলছে, এই চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে। সর্বশেষ পুলিশ সদর দফতরে অপরাধবিষয়ক ত্রৈমাসিক সভাতেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্কোপোলামিন একধরনের গাছের বীজ থেকে তৈরি পাউডার, যা নিশ্বাসের মাধ্যেম শরীরে প্রবেশ করার পর মস্তিস্ককে অল্প সময়ের জন্য বিস্মৃত করে দেয়। স্কোপোলামিনকে ‘শয়তানের নিশ্বাসও’ বলে থাকেন অনেকে। এই মাদকে আক্রান্ত ব্যক্তি সাময়িক সময়ের জন্য কাউকে চিনতেও পারে না। শরীর ও মনের ওপর দখল হারিয়ে ফেলায় তাকে যে কেউ নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, ভয়ংকর মাদক স্কোপোলামিনের মাধ্যমে টার্গেট করা ব্যক্তিকে দিয়ে যেকোনও ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ করানো সম্ভব। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে টার্গেট করা নারী বা পুরুষের শরীরে এই মাদক ঢুকিয়ে দিয়ে অপরাধী চক্র তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এ ছাড়া পানির সঙ্গে মিশিয়েও পান করানো হচ্ছে এই মাদক। শ্বাস-প্রশ্বাস কিংবা পানি খাওয়ার মধ্য দিয়ে টার্গেট করা ব্যক্তি অপরাধীদের ‘হাতের পুতুলে’ পরিণত হয়।

অধিদফতরের প্রধান রাসায়নিক কর্মকর্তা দুলাল চন্দ্র বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্কোপোলামিন নামের এই মাদকটি হ্যালুসিয়েশন সৃষ্টি করে থাকে। মাদক মাখা কোনও কাগজ টার্গেট ব্যক্তির সামনে এনে ধরলে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে তার শরীরে ঢুকে যায়। তখন ওই ব্যক্তি অপরাধীর ‘হাতের পুতুল’ হয়ে যান। এক কথায় রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে যেভাবে কোনও কিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয়, ঠিক সেভাবেই টার্গেট ব্যক্তিদের এই মাদক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।’

পুলিশ সদর দফতর বলছে, সারা দেশে এই চক্রের অন্তত ৭০ থেকে ৮০ জন সদস্য রয়েছে। যাদের বেশিরভাগই ইরানি নাগরিক। গত ছয় মাস তাদের মধ্যে থেকে অন্তত ১৭ জন বিদেশি নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়েছে।

পল্লবী থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলার সূত্রে জানা গেছে, গত জানুয়ারি মাসে রাজধানীর মিরপুর ডিওএইচএস শপিং কমপ্লেক্সের একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে প্রবেশ করেন দুই ইরানি নাগরিক। তারা হলেন পারভিজ মোহাম্মদ ও মেইস্যাম গোরবানি। সে সময় দোকানে মালিক রাকিব না থাকায় একাই বসে ছিলেন সহকারী জিসান। উড়োজাহাজের টিকিটের কথা বলতে বলতে জিসানের নাকের সামনে দিয়ে ডান হাত ঘুরিয়ে নিয়ে যান পারভিজ মোহাম্মাদ। এরপর কয়েক মিনিটের জন্য আর কিছু মনে করতে পারেনি জিসান। পরে প্রতিষ্ঠানের সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ে ওই দুই বিদেশির একজন জিসানের সামনে থাকা ক্যাশবক্স থেকে দেশি বিদেশি সাড়ে ৪ লাখ টাকা ব্যাগে ভরে নেয়। এসময় তারা জিসানের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছিলেন। জিসানও নিজের ইচ্ছায় টাকাগুলো তুলে দেন ইরানি দুই নাগরিকের হাতে। দুই ইরানি নাগরিক চলে গেলে জিসান বুঝতে পারে তিনি প্রতারকের খপ্পরে পড়েছিলেন। পরে ওই ঘটনায় পল্লবী থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।
 
ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পল্লবী থানার উপপরিদর্শক চিন্ময় সরকার জানান, ইরানি দুই নাগরিক মূলত প্রতারক। তারা অভিনব কৌশলে মাদক ব্যবহার করে সর্বস্ব লুট করে। ঘটনার পর তারা অভিযান চালিয়ে মেইস্যাম গোরবানিকে গ্রেফতার করতে পারলেও পারভিজ দেশ ছেড়ে চলে গেছে।

চিন্ময় সরকার জানান, তারা দুজনই মালদ্বীপ থেকে ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল। এই চক্রের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করে সুযোগ বুঝে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ চুরি করে বেড়াচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ইরানি নাগরিকদের এই চোর চক্রের সদস্যরা ভ্রমণ ভিসায় বিভিন্ন দেশে ঢুকছে। পরে আশপাশের দেশে একই কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে তারা বাংলাদেশে আসে। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়ানোর নামে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টার্গেট করে। যেসব প্রতিষ্ঠানে একজন-দুজনকে পান সেই দোকান বা প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে ভেতরে গিয়ে নানা বাহানার এক পর্যায়ে স্কোপোলামিন নাকের কাছে নিয়ে সব হাতিয়ে নিয়ে যান।

গত ৪ আগস্ট বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা সদরের হৃদয় টেলিকম থেকে একই কৌশলে ১ লাখ টাকা চুরি করেন আজাদ নুবাহার ও আরসাদ আমন নামের দুই ইরানি নাগরিক। ঘটনার চার দিন পরে উত্তরবঙ্গ ছাড়ার পথে বগুড়া জেলা পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। বগুড়ার শিবগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুর রউফ বলেন, দুই ইরানি যুবক ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আসে। এরপর থেকে তারা সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ এই কৌশলে চুরি করতে থাকে। তাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে তারা পেশাদার অপরাধী।

গত ৮ এপ্রিল যশোরের অভয়নগর উপজেলার বর্ণী হরিশপুর বাজারের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দোকান মরিয়ম স্টোরে প্রবেশ করেন দুই ক্রেতা। এরপর মালিক শরিফুল ইসলামকে একই প্রক্রিয়ায় বিস্মৃত করে তারা। এক পর্যায়ে চক্রের সদস্যদের কথা মতো শরিফুল নিজেই তাদের হাতে তুলে দেন ৬ লাখ টাকা। এ ঘটনায় তিন ইরানি নাগরিক খালেদ মহিবুবী, সালার মাহবুবী ও ফারিবোরয মাসুফিসহ সাত জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেলাল হোসাইন জানিয়েছেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে সারা দেশের ৩৩টি জেলাতে তাদের চক্রের সদস্যরা সক্রিয় রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, স্কোপোলামিনকে বুরানডাঙ্গা নামেও ডাকা হয়। এটাকে সারা বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ মাদক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি সাধারণত ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। অপরেশন পরবর্তী সময়ে রোগীর বমি নিবারণসহ অন্যান্য কারণে এটিকে ব্যবহার করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ওভারসিস সিকিউরিটি এডভাইসরি কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী কলম্বিয়া ও ইকুয়েডরে এটি ব্যপকভাবে চুরি বা ডাকাতির কাজে ব্যবহার হচ্ছে। সম্প্রতি ফ্রান্সেও এই মাদক ব্যবহার করে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে এই মাদক দিয়ে চুরি ডাকাতি করছে বিদেশি চোর চক্র। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিমানবন্দরে নিরাপত্তা চৌকি পার করে কীভাবে দেশের বাইরে থেকে এই মাদক আনা হচ্ছে তাও খতিয়ে দেখা শুরু করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

আরও পড়ুন

ভয়ংকর মাদক স্কোপোলামিন: টার্গেট ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় অপরাধীর হাতে