Jadavpur Row: ‘নিশানায় যাদবপুরের সব পড়ুয়া, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী! এগুলি তাঁদের প্রাপ্য কি?’

নন্দিনী মুখোপাধ্যায়

 

গত ১০ আগস্ট যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া একটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা নিয়ে রাজ্য তোলপাড়। প্রথম বর্ষের এক ছাত্র এসেছিল অনেক স্বপ্ন নিয়ে। কিছু বিকৃত মানসিকতার ছেলেদের নির্যাতনের শিকার হয়ে এই ভাবে চলে যাওয়া যাদবপুর এখনও মেনে নিতে পারেনি। 

কিন্তু তারপর থেকেই গত ১৫ দিন ধরে সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের কাঠগড়ায় গোটা যাদবপুর। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১৬০০০ ছাত্র, ৬০০ জন শিক্ষক এবং প্রায় ২০০০ শিক্ষাকর্মী, আধিকারিক রাতারাতি সমাজের চোখে খলনায়কে পরিণত। কত কথাই তো উঠে আসছে এই বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে। যাদবপুরে র‌্যাগিং তো হয়, তার সঙ্গে কুড়িয়ে পাওয়া যায় মদের বোতল, হয় গাঁজার চাষ, ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা না করে এমন কিছু কাজকর্ম করে, যা আসামাজিক ইত্যাদি ইত্যাদি। সংবাদ মাধ্যমের প্রাইম টাইম জুড়ে এই সমস্ত খবরের ঠেলাতে পাড়ায় পাড়ায় বসছে খাপ পঞ্চায়েত। সহকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বলছেন পাড়া প্রতিবেশীর কাছ থেকে শোনা অসম্মানজনক মন্তব্যের কথা। ছাত্রছাত্রীরা বলছে, তারা বাস থেকে নামার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে নামছে না, নামছে আরও দু’-এক স্টপ এগিয়ে। এটাই কি প্রাপ্য ছিল রাজ্যে প্রথম এবং দেশে চতুর্থ স্থান দখল করা বিশ্ববিদ্যালয়ের?

যাদবপুরের প্রশাসনিক শৈথিল্য নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান শহরের একটি বসতিপূর্ণ এলাকায়, যেটা কলকাতার অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির থেকে ভিন্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে কোনও বাধা নিষেধ নেই। যখন তখন যে কেউ প্রবেশ করতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকরা এই বাধা নিষেধ রাখতেও চাননি। অতীতে এই নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে। ফলে সকালে প্রাতঃভ্রমণে আসেন আশেপাশের বয়স্ক মানুষজন, আর একটু বেলা হলে দেখা যায় স্কুলের ছাত্র ছাত্রী ও তাদের মায়েদের, এবং পথচলতি বহু মানুষ যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া পথ ব্যবহার করেন কিছুটা সামনে অত্যন্ত ব্যস্ত এবং ঘিঞ্জি রাস্তা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য। আসেন বহু মানুষ নানাধরনের পঠনপাঠন বিষয়ক কাজের জন্য। সন্ধ্যার পর রাত নটা পর্যন্ত চলে নাইট ক্লাস। কিন্তু এইসময়েও ক্যাম্পাসে ঘোরাফেরা করেন বহু বাইরের মানুষ, যেহেতু কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। ১৬০০০ ছাত্রছাত্রীর প্রায় সকলেই ডে স্কলার, ক্লাসের শেষে বাড়ি বা মেসে ফিরে যায়। হোস্টেলে থাকার সুযোগ পায় সর্বসাকুল্যে হাজার থেকে বারোশো ছাত্রছাত্রী। তাই যে অসামাজিক বিষয়গুলির কথা সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসছে তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কত শতাংশ ছাত্রছাত্রী দায়ী আর কতটা বাইরে থেকে আসা কিছু নাগরিক, সে বিষয়ে নিশ্চয় প্রশাসনিক তদন্ত হওয়া উচিত। নিরাপত্তা কর্মীদের নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন এবং নিরাপত্তা কর্মীদের হাতে ক্ষমতা দেওয়াও দরকার যাতে তাঁরা দরকার মতো ব্যবস্থা নিতে পারেন।

কিন্তু একটি ঘটনাকে ঘিরে র‌্যাগিংয়ের মতো অপরাধকে নির্মূল করা ও অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার থেকে বেশি দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাহানির চেষ্টা। এটা কি আদৌ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্য ছিল? যে কোনও দেশে, যে কোনও শহরে এই ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে সযত্নে রক্ষা করা হয়, কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি সমাজে দান করে অমূল্য মানব সম্পদ যারা দেশের জন্য, শহরের জন্য নিয়ে আসতে পারে গৌরব, সম্মান। ১৬০০০ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে র‌্যাগিং-এর ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ধরা পড়েছে ১২ জন। আরও কেউ ধরা পড়বে কি না জানা নেই। যারা দোষী তাদের চরমতম শাস্তি হোক। হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ০.১ শতাংশ ছাত্র এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থেকেছে। তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত মেধাবি ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের ভিলেন বানিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। 

আর একটা কথা বলা দরকার। এই মুক্ত আবহাওয়া বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ ও শিল্প সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে ও তার দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে যেতে সব সময়েই সাহায্য করেছে। জানলা খুলে রাখলে খোলা হাওয়ার সঙ্গে পোকামাকড়ও ঢুকে আসে। কিন্তু তার জন্য কি আমরা জানলা বন্ধ করে রাখি?   

 

(লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত)