Jadavpur Row: ‘রামকৃষ্ণ মিশনের হোস্টেলেও কি র‌্যাগিং হয়? অনেকেরই প্রশ্ন এটি! উত্তরটা খুব সহজ’

গৌতম সিনহা

 

যাদবপুর। র‌্যাগিং। হোস্টেল জীবন। সিসিটিভি ক্যামেরা। 

এই শব্দগুলি এখন প্রতি দিন সকালের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি শব্দের নিশানায় দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জীবনের প্রতিটি বাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা কেউ না কেউ। তাঁদের মধ্যে কেউ বা আক্রমণকারী, দোষী। কেউ আক্রান্ত। কারও ক্ষেত্রে আবার সীমারেখাটা বোঝা দায়। 

তবু এ সবের মধ্যেই বারে বারে ফিরে এসেছে একটাই প্রশ্ন। হোস্টেল জীবনের সঙ্গে সমান সমান চিহ্নের সম্পর্কে কি দাঁড়িয়ে আছে র‌্যাগিং? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আমার মন চলে যায় আজ থেকে ৪৩ বছর আগের একটি দিনে। আমার হোস্টেল জীবনের শুরু। 

নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন। কলেজ জীবনের প্রথম দিন। হোস্টেল জীবনেরও। কেন এই দিনটি দিয়ে লেখা শুরু করলাম? কারণ, নরেন্দ্রপুর-সহ বেশ কয়েকটি রামকৃষ্ণ মিশনই পুরোপুরি আবাসিক। অর্থাৎ এখানে পড়তে গেলে হোস্টেলে থাকতেই হবে। যেখানে হোস্টেল জীবনের সঙ্গে র‌্যাগিং শব্দটি প্রায় সমানুপাতিক হারে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেখানে এই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, ‘তাহলে কি রামকৃষ্ণ মিশনেও র‌্যাগিং হয়? সিনিয়ররা জুনিয়ারদের হেনস্থা করে?’ আমার উত্তর খোঁজা এখান থেকেই। ৪৩ বছর আগের একটি দিন থেকে। 

সেটা ছিল ‘বিদ্যার্থী ব্রত’র দিন। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে যেমন ব্যাপটাইজেশন, এও যেন মিশনের ক্ষেত্রে তাই। তবে এখানে ধর্মের বিধান ছিল, ছিল আচার আর নিয়মরীতির কিছু আনুষ্ঠানিকতা। সব মিলিয়ে নতুন ছাত্রদের মিশনে গ্রহণ করার প্রক্রিয়া। গ্রহণ হল। এবার কি বড়দের হাতে হেনস্থা হওয়ার পালা?

নরেন্দ্রপুরের হোস্টেলে তিনটি ভবন ছিল। ব্রহ্মানন্দ, গৌরাঙ্গ এবং রামকৃষ্ণানন্দ ভবন। প্রতিটি ভবন আবার তিনটি তলার। একেবারে নীচের তলায় এগারো-বারো ক্লাসের ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা। আর উপরের তলাগুলিতে কলেজের তিনটি বর্ষের ছাত্রদের। 

এর আগে অন্যান্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করা পরিচিতদের মুখে ‘র‌্যাগিং’ শব্দটি শুনেছিলাম। কলেজের প্রথম দিনে, অর্থাৎ হোস্টেল জীবনের প্রথম দিনেই টের পেলাম, সেই শব্দ এখানে মাথায় রাখার প্রয়োজনটাই নেই। কারণ এখানে শুধু সিনিয়র-জুনিয়র ছাত্ররাই হোস্টেলে থাকেন না, থাকেন মহারাজ এবং অন্য অধ্যাপকরাও। ফলে নিরন্তর নজরদারির কোনও খামতি নেই। নেই নতুন নিরাপত্তার অভাবও। 

যে প্রশ্ন দিয়ে লেখা শুরু হয়েছিল ‘রামকৃষ্ণ মিশনের হোস্টেলেও কি র‌্যাগিং হয়?’ এবার তাড়াতাড়ি তার সহজ উত্তরেই চলে আসি। না, রামকৃষ্ণ মিশনের বেশ কিছু কলেজ (এবং স্কুল) আবাসিক হওয়া সত্ত্বেও সেখান র‌্যাগিং নামক আচরণের উপস্থিতি নেই। মানে, অন্তত সেই সময়ে তার লেশমাত্র ছিল না। কিন্তু তার কারণ কি শুধুই নজরদারি? কড়া মনোভাব? হোস্টেলে মহারাজ বা অধ্যাপকদেরও উপস্থিতি? এমনটা ভাবলে ভুল হবে। 

কেন ছিল না রামকৃষ্ণ মিশনে ‘র‌্যাগিং’? প্রথমেই এ জন্য বলতে হবে, অনুশাসন ও কাঠামো। প্রথমত, এই কলেজে এমন ছাত্রদেরই ভর্তির সুযোগ হত, যাঁরা পড়াশুনায় রীতিমতো ভালো। বেশ একটা মাথা গুঁজে সারা দিন পড়ে যাওয়া মার্কা ছাত্ররাই বোধহয় এই ধরনের কলেজে অ্যাডমিশন নিতেন। সকাল থেকে উঠে দাঁত মাজার আগে বই খুলে বসাটাও হয়তো অনেকের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হত। 

আবার এই মিশনেই খেলাধুলোর উপর কম জোর দেওয়া হত না। বিকেল হলে মাঠে যেতেই হবে। কেউ ফুটবল, কেউ বাস্কেটবল খেলবেন। কেউ হয়তো শুধু বসে থাকবেন। কিন্তু সেটি মাঠেই। হোস্টেলের ঘরে বসে থাকলেই জুটত বকা। আমি যখন মিশনের ছাত্র, তখন মাঠ পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন প্রশান্ত গিরি স্যর (যদিও আমরা প্রশান্তদা বলেই ডাকতাম। তিনিই হলেন সংখ্যাতত্ত্বের দিকপাল মাস্টারমশাই। গিরি-ব্যানার্জির বই তো বহু ছাত্রছাত্রীই পড়েছেন)। খেলার সময়ে খেলো, বাকি সময় পড়ো। খাওয়াদাওয়া করো, নিয়ম করো ঘুমোও। বন্ধুদের সঙ্গে সুখদুঃখের গল্প করো। এই ছিল মোটের উপর জীবন। 

দ্বিতীয় একটি কারণও ছিল কলেজের মধ্যে সমস্যা না হওয়ার। কোনও রাজনৈতিক দলের সংগঠনের অনুপস্থিতি। রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞান বাড়াতে অসুবিধা নেই। কিন্তু কোনও দলাদলি কখনও ঢুকতো না কলেজের মধ্যে। সব মিলিয়ে ঝামেলার জন্য যা যা দরকার, তার চেয়ে শত হস্ত দূরে দাঁড়িয়ে ছিল সেদিন রামকৃষ্ণ মিশন। হয়তো আজও তাই। 

সিনিয়র দাদাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কেমন ছিল? অনেকেই র‌্যাগিং-সপক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলেন, এতে নাকি সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো হয়। আমাদের কলেজে সে সম্পর্ক কেমন ছিল, জানি না। তবে এটুকু বলে পারি, ‘দাদা’দের আমরা চিনতাম এই ভাবে— ‘ওই দাদাটা ফুটবলে ভালো’, ‘ওই দাদাটা অঙ্কে ভালো’। পরীক্ষার আগে প্রয়োজন মতো সেই দাদার থেকে নোটস নেওয়া বা পরামর্শ নেওয়ার ক্ষেত্রেও অসুবিধা হত না। 

এত ক্ষণ লেখার পরে টের পেলাম, আমার লেখা থেকে নরেন্দ্রপুর হোস্টেল সম্পর্কে সকলের (যাঁরা সেখানে পড়েননি, বা ভিতরের পরিবেশ সম্পর্কে জানেন না) মনে হতে পারে, দমবন্ধ করা পরিবেশ, জেলখানার মতো। না, বিষয়টা তেমনও নয়। 

গেটপাস না পেয়ে পাঁচিল টপকে আমরাও সিনেমা দেখতে গিয়েছে। লুকিয়ে গড়িয়াহাটের রেস্তরাঁয় খেতে গিয়েছি। ধরা পড়ার ভয় ছিল। কিন্তু ধরার পড়ার পথ আগলে দাঁড়িয়ে থাকত ওই সিনিয়র দাদারাই। বলে দিত, কোন সময়ে কেটে পড়লে, ধরার পড়ার আশঙ্কা কম। স্টাডি আওয়ারে হয়তো পড়তে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু কোন সময়ে বই খুলে বসে না থাকলেই নয়, গার্ডের হাতে পড়তে হবে— তাও বলে দিত ওই দাদারাই। এভাবেই নাম ভুলে যাওয়া দাদারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত। 

হয়তো পরিবেশটাই এমন ছিল, যা এমনিই বন্ধন তৈরি করে দিত পুরনো ছাত্রদের সঙ্গে নতুনদের। দুই ক্লাসের মধ্যে সংযোগের জন্য তাই ‘র‌্যাগিং’ নামক মাধ্যমের প্রয়োজন হত না।

তবে এই কড়া নিয়মের কারণে সমস্যাও যে হয়নি, তা নয়। শেষে এটুকু বলতেই হবে। একবার কলেজ থেকে আমাদের দু’-তিন জন (সংখ্যাটা এখন আর মনে নেই) সিনিয়রকে বহিষ্কার করা হয়। শোনা গিয়েছিল, তাদের অপরাধ— তাঁরা নাকি কোনও এক জুনিয়রকে খারাপ কথা বলেছেন। এমন সেই কথা, যা আজকের যুগে হয়তো তেমনভাবে নিন্দনীয়ও নয়।  

ব্যস, এইটুকুই। এর পরেই ওই দু’-তিন জনকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ওই ঘটনা আমাদের মধ্যে এক মিশ্র অনুভূতি তৈরি করেছিল। মনে হয়েছিল, এই শাস্তি হয়তো মিশনের ভাবধারার সঙ্গেও মিলছিল না। অনেকেরই মনে হয়েছিল, এটি বোধহয় লঘু পাপে গুরু দণ্ড। ওই দাদাদের প্রত্যেকেই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। পরবর্তী কালে তাঁদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করেছেন। হয়তো এমন ধারা শাস্তি না হলেও সেদিন হত। 

র‌্যাগিং নামক অসভ্যতা যদি একদিকের চরম অবস্থা হয়, তাহলে এই নিয়মের কড়াভাব হয়তো আর এক চরম অবস্থা। ‘দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমানে আঘাতে সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।’ দণ্ডদাতা কি সেদিন সত্যিই সে আঘাত পেয়েছিলেন? 

তবু আজ এখানে দাঁড়িয়ে মনে হয়, মিশনের দিনগুলি বেশ ছিল। ভাইদাদাদের সঙ্গে মিলেমিশে বছর তিন তো খারাপ কাটেনি। মিশন কর্তৃপক্ষের বজ্রআঁটুনির কারণে র‌্যাগিং নামক ভয়ঙ্কর কিছুর অভিজ্ঞতা হয়নি ঠিকই, কিন্তু তার চেয়ে বেশি করে বোধহয় কাজ করেছিল আরও একটি জিনিস। পড়াশুনাকে ভালোবেসে কতগুলো সম-মনের ছেলেপুলের এক জায়গায় জড়ো হওয়া। 

প্রতি দিন সকালে যখন সংবাদমাধ্যম সূত্রে পাওয়া ওই বীভৎস শব্দগুলির সামনে রোজ আমাদের সকলকে দাঁড়াতে হচ্ছে, তখন এই অনাচারি সময়ে পিছন ফিরে তাকালে মুখে এসে লাগে মিশনের দিনগুলির ভাইবেরাদারগিরির তাজা বাতাস। তাতে নিঃশ্বাস নিই প্রাণভরে। সেখানে কোনও আশঙ্কা নেই, উদ্বেগ নেই, হেনস্থা হওয়ার সুযোগ নেই। মিশনের গরম ইস্তিরির আঁচ বেনিয়মের ভাঁজগুলিকে সিধা করে দেওয়ার চেষ্টা করত। আর তাই বেশি গরমে মাঝে মধ্যে তা থেকে স্বল্প পোড়া বাসও বার হত। কিন্তু তা নেহাতই বিরল। বাকিটা স্রেফ সুন্দর, স্রেফ মনের মতো। 

 

(লেখক হিন্দুস্কুলের স্ট্যাটিসটিকস বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষক। রামকৃষ্ণ মিশন আবাসিক কলেজ, নরেন্দ্রপুরের প্রাক্তন ছাত্র। মতামত ব্যক্তিগত