জোহানেসবার্গ, ক্যাম্পডেভিড ও ডলারের রাজ

২০০৯ সালে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন মিলে “ব্রিকস” (BRICS) নামে নতুন এই ইকোনমিক ফ্রন্টটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে। ২০১২ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ব্রিকস সামিটে এই জোটের আওতায় একটি নতুন ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক – “ব্রিকস ব্যাংক” গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। বাস্তবে এই জোট ও ব্যাংকের সিদ্ধান্তের পেছনে এই শতাব্দীর শুরু থেকেই পশ্চিমা দুটি বড় অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান প্রচ্ছন্ন ও তাত্ত্বিকভাবে কাজ করে। তারা অর্থনীতির হিসাব-নিকাশে দেখতে পাচ্ছিল– গ্লোবাল সাউথে যে নতুন অর্থনৈতিক বুম হতে যাচ্ছে তাকে একটা সাংগঠনিক কাঠামোয় আনা দরকার। তাহলে পৃথিবীর সার্বিক অর্থনীতি ও এই বড় বড় অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হবে।

জোটটি যখন আত্মপ্রকাশ করে সে সময়ে বোঝা যাচ্ছিল যে পৃথিবী খুব দ্রুতই নতুন করে একটি স্নায়ুযুদ্ধের রাজনীতিতে প্রবেশ করবে; এবং সেটা সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকাকালীনে উত্তেজনাময় স্নায়ুযুদ্ধ না হলেও একেবারে কম হবে না। তবে, ওই সময়ের হিসেবের থেকে আরও দ্রুতগতিতে স্নায়ুযুদ্ধে ঢুকে গেছে পৃথিবী। মোটা দাগে, তিনটি কারণে এই দ্রুতগতির পরিবর্তন–

এক. তরুণ জনশক্তি এবং পশ্চিমা টেকনোলজিকে যথেষ্ট সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে চীন অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে সবার বিশ্লেষণকে ছাড়িয়ে খানিকটা বেশি এগিয়ে গেছে।

দুই.  প্রায় দুই বছর ধরে চলা কোভিড প্যান্ডেমিক পৃথিবীর অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি বদলে দিয়েছে।
তিন. যেকোনও প্যান্ডেমিকের ভেতর দিয়ে যখন অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি এভাবে বদলে যায় তখন ইতিহাসে দেখা যায়, কোনও না কোনও স্বৈরশাসক গোটা পৃথিবীকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলে।

এবারও রাশিয়া সে কাজটি করেছে। এ রকম একটি স্নায়ুযুদ্ধমান পরিবর্তিত সময়ে এবারের ব্রিকস সামিট অনুষ্ঠিত হয় সাউথ আফ্রিকায়। ২০২৩ সালে এই ব্রিকস সামিটের চরিত্র এর আগের সামিটগুলো থেকে বেশ ভিন্ন। কারণ, এবার এই সামিটে মূল পাঁচ দেশের পারস্পরিক অবস্থান ভিন্ন রকম। ব্রিকস যখন গঠিত হয়, সে সময়ে চীন ও ভারতের সম্পর্ক যা ছিল, এখন সেটা বেশ বিপরীতে। ঠিক একই অবস্থা ভারত ও রাশিয়ার ভেতর। ভারত এখন রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত অর্থনৈতিক সম্পর্ক গাঢ় রাখলেও প্রতি মুহূর্তেই রাশিয়ান অস্ত্র বা প্রাক্তন ‘ওয়ারস -ক্লাব’ আর্মস থেকে বেরিয়ে এসে ‘ন্যাটো ক্লাবের’ আর্মসকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করছে। অন্যদিকে, ইউক্রেন আক্রমণ করার ফলে রাশিয়া এখন পশ্চিমা অর্থনৈতিক অবরোধে বেশ কাবু হয়ে চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বের বদলে প্রতিদিনই চীন নির্ভরতার দিকে চলে যাচ্ছে।

পশ্চিমা এই অর্থনৈতিক অবরোধের মূল অস্ত্র বিশ্বব্যাপী মুদ্রা বাজারের রাজা হিসেবে ডলারের রাজত্ব। গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষকেরা নন, অতি আশাবাদী কিছু কিছু বিশ্লেষক অনেকটা এমনই মনে করেছিলেন– বর্তমানের এই চলমান পরোক্ষ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মূল অস্ত্র ডলারের ক্ষমতা কমানোর উদ্দেশ্যে এবারের ব্রিকস সামিটে এই জোটের সদস্য সংখ্যা অনেক বেশি বাড়ানো হবে। এবং গতিশীল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে ব্রিকস ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে– যা অন্য কোনও মুদ্রার মাধ্যমে আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংক-এর ব্যবহৃত আমেরিকান ডলারের বিপরীতে ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। বাস্তবে এ দুটোর কোনোটাই ঘটেনি। এর কারণ, আগেই কিছুটা উল্লেখ করেছি যে এ মুহূর্তে ব্রিকস-এর মূল সদস্যদের অবস্থান বদলে গেছে। তাই, ব্রিকস-এর যেই ছয় দেশকে নতুন সদস্য করা হয়েছে সেখানে ব্রিকস-এর থেকেও বেশি বিবেচনায় এসেছে ইন্দো-প্যাসিফিক সামরিক ও অর্থনৈতিক জোটের সদস্য– ভারতের ও ইন্দো-প্যাসিফিকের বিপরীতে চীনের প্রয়োজনীয় দেশকে। শেষ মুহূর্তে যে ছয়টি দেশকে এ সদস্যপদ দেওয়া হয়েছে তাদের অবস্থান বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি স্পষ্ট, ভারত এবং চীন অনেকটা ভাগাভাগি করে নিজ নিজ প্রয়োজনীয় এবং বিশ্বস্ত দেশকে সদস্যপদ দিয়ে ব্রিকস-এ ক্ষমতার পারস্পরিক ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে।

অন্যদিকে, ব্রিকস ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে গতিশীল করা বা নতুন কোনও একক মুদ্রার খুব একটা কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। আর এটা ঘটাই ছিল স্বাভাবিক। কারণ, ব্রিকস-এর মূল পাঁচ দেশের ভেতর এ মুহূর্তে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী পর্যায়ে রয়েছে চীন ও এর পরবর্তীতে ভারত। চীনের থেকে ভারতের অর্থনীতির পরিমাপ ছোট হলেও দুই দেশই চলার গতি প্রায় সমান্তরালে রাখার চেষ্টা করছে। চীন যেমন চাঁদে তাদের নাম লেখানোর পরপরই ভারতও তাদের নাম লিখিয়েছে। মুদ্রার ক্ষেত্রেও দুই দেশই এভাবে সমানভাবে পাল্লা দিচ্ছে। চীন যেমন ধীরে ধীরে গ্লোবাল সাউথে তাদের মুদ্রা ইউয়ানকে একটি সরাসরি বিনিময়যোগ্য মুদ্রা হিসেবে ছড়িয়ে দেওয়ার নীতি নিয়ে এগোচ্ছে, ভারতও তাদের রুপিকে একইভাবে গ্লোবাল সাউথে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা হিসেবে দাঁড় করানোর পথে চলেছে। বস্তুত, অর্থনৈতিক অবরোধে পড়ে রুবল একঘরে হয়ে পড়ায় এখন ব্রিকস-এ মূল সদস্যদের ভেতর ইউয়ান ও রুপি শক্তিশালী এবং এ দুটোই নিজস্ব সক্ষমতা ও বিনিময়ের বাজার বাড়ানোর নীতি নিয়েছে। তাই, এর থেকে স্পষ্টই বলা যায়, খুব নিকট ভবিষ্যতে ব্রিকস ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-এর মাধ্যমে ডলারের বিপরীতে নতুন কোনও একক মুদ্রার জন্ম হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।

আবার, নতুন সদস্য নেওয়ার ক্ষেত্রে চীন ও ভারতের অর্থনৈতিক ও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সামরিক স্বার্থ গুরুত্ব পাওয়া এবং সেভাবে সদস্য ভাগাভাগি করে নেওয়াতে ব্রিকস জোটের ভবিষ্যৎ কার্যক্রমেরও অনেকটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। একেবারে শতভাগ না হলেও, রাশিয়া পিছিয়ে পড়ে যাওয়ার পরে এখন মূলত ব্রিকসকে চীন এবং ভারত তাদের নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী কে কতটা তাদের পক্ষে কাজে লাগাতে পারে সেটাই এখানে বেশি ক্ষেত্রে দেখা যায়।

চীন এবং ভারত ব্রিকসকে এভাবে নিজ নিজ কাজে লাগালেও গ্লোবাল সাউথের অর্থনৈতিক বুমকে সংগঠিত রূপ দেওয়ার জন্য এই শতকের শুরুতে যে হিসাব করা হয়েছিল সে হিসাব এখন অনেকটা বদলে গেছে। কারণ, ওই সময়ের হিসাবের থেকে চীন তার সামরিক শক্তিকে অনেক দ্রুত এগিয়ে নিয়ে এসেছে। পাশাপাশি, গ্লোবাল সাউথে চীন তাদের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের কাজকেও দৃশ্যমান করে তুলেছে। যে কারণে, এর বিপরীতে ইন্দো-প্যাসিফিক সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট “কোয়াড” (QUAD) কোভিডের আগ পর্যন্ত একটি সিদ্ধান্তের ভেতর থাকলেও বর্তমানে তা বাস্তব এবং অনেক বেশি সক্রিয়। শুধু তাই নয়, এই ইন্দো-প্যাসিফিক জোটের অন্যতম সদস্য ভারত যখন জোহানেসবার্গের ব্রিকস সামিটে যাচ্ছে, তার মাত্র কয়েক দিন আগেই ইন্দো-প্যাসিফিকের গ্লোবাল সাউথের আরেক অন্যতম সদস্য– জাপান ও চীনের প্রতিবেশী, এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি- সাউথ কোরিয়াকে নিয়ে আমেরিকা ক্যাম্প ডেভিডে বসে নতুন আরেকটি সামরিক চুক্তি করে। যার মূল উদ্দেশ্য– সাউথ চীন সি-তে আমেরিকা, সাউথ কোরিয়া ও জাপানের নিয়মিত সামরিক মহড়া দেওয়া। বস্তুত, এই ক্যাম্প ডেভিড সিদ্ধান্তের অনেক দিকের ভেতর নিঃসন্দেহে একটা দিক ছিল ব্রিকস সামিটকে কিছুটা বার্তা দেওয়া। আর সে বার্তার  প্রভাবও ব্রিকস-এর নতুন সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও দেখা গেছে। তাই এই নতুন একের পর এক স্নায়ুযুদ্ধের ভেতর দিয়ে ব্রিকস-এর খুব শক্তিশালী স্বতন্ত্র অবস্থানের জায়গা খুব কি খোলা আছে?

লেখক: সাংবাদিকতায় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত