তৃণমূলে ঋণের বোঝায় কেন বাড়ছে আত্মহত্যা

গত ৪ সেপ্টেম্বরের ঘটনা। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে মোহাম্মদ আরিফ হোসেন (২৩) নামে এক ব্যবসায়ী আত্মহত্যা করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের আইডিতে ‘ক্ষমাপ্রার্থী’ স্ট্যাটাস লিখে ওইদিন সন্ধ্যায় উপজেলার ১৬ নম্বর সাহেরখালী ইউনিয়নের পূর্ব সাহেরখালী গ্রামে নিজ বাড়িতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।

এর আগে ছড়িয়ে পড়ে জয়পুরহাটের আক্কেলপুরের রানীর কথা। রানীর বাবা মাসুদ রানা অটোভ্যানচালক। ভ্যানের চাকা ঘুরলে তার সংসার চলে। মেয়ে রানী আর স্ত্রী হীরামণিকে নিয়ে সংসার। তাদের নিজস্ব কোনও জমি নেই। একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ঘর তোলার জন্য জমিও কেনেন। সেই জায়গায় একটি মাটির ঘর তৈরি করেন। ছোট সংসার হলেও সব সময় দুশ্চিন্তায় থাকেন মাসুদ রানা। এরপর ছোট ছোট স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে একের পর এক ঋণ নিতে থাকেন, কিন্তু কাজ করতে পারেন না। এনজিও টানা ঋণ দিয়েছে বটে, কিন্তু একসময় সেটা তিন লক্ষাধিক টাকা হলে চাপও বাড়ে। কিস্তি দিতে না পেরে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন মাসুদ রানা।

দেশে প্রতি বছর ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে কত জন আত্মহত্যা করেন, তার প্রকৃত সংখ্যা জানা যায় না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদপত্রে এ ধরনের খবরের সংখ্যা বেড়েছে। অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, কোভিড মহামারির সময়ের পর দেশে বিভিন্ন বয়সীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। কিন্তু বিষয়টিকে সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে এই প্রবণতা রোধে তেমন কোনও উদ্যোগ দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে আজ  (১৯ সেপ্টেম্বর) পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। এবার আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে— ‘কর্মের মাধ্যমে আশা তৈরি করা।’

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সুরক্ষিত বিনিয়োগ নিশ্চিত করা, ক্ষুদ্রঋণ নিতে এনজিওগুলো যেন প্রভাবিত না করতে পারে, সেই ব্যবস্থা করার মাধ্যমে কাজের নিশ্চয়তা দিতে পারলে হতাশাগ্রস্ততা কমবে এবং এ ধরনের আত্মহত্যার ঘটনা কমে আসবে।

উল্লেখ্য, কেবল বাংলাদেশে  না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও নানা সময়ে কৃষক ও শ্রমিক পর্যায়ের জনগণকে আত্মহত্যার শিকার হতে দেখা যায়। ২০২২ সালে সাড়া ফেলেছিল ভারতের মেদিনীপুরের নির্মম ঘটনা। তথ্যের অধিকার আইনে (আরটিআই) পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় কৃষকদের মৃত্যু সম্পর্কে তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছিল। নিয়মানুসারে এ তথ্য জানতে চান আরটিআই কর্মী বিশ্বনাথ গোস্বামী। পুলিশ-প্রশাসনের দেওয়া তথ্য বলছে, ২০২১ সালে ওই জেলায় ১২২ জন কৃষক ও চাষবাসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পেশাজীবী আত্মহত্যা করেছেন। অর্থাৎ, শুধু চাষি নন, কৃষিকাজের সঙ্গে যাদের জীবিকা জড়িয়ে রয়েছে, তাদেরও এই তালিকায় রাখা হয়েছিল।

কয়েকটি দিক রাষ্ট্র বিবেচনায় নিলে এ ধরনের হতাশা  থেকে ব্যবসায়ী ও তরুণদের বের করে আনা সম্ভব হবে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একজন ব্যবসা করতে গিয়ে উচ্চহারে সুদের বিনিময়ে ক্ষুদ্রঋণ নিচ্ছে। কিন্তু যেখানে বিনিয়োগ করছে, সেগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার জন্য নিরাপদ না। সেকারণে পক্ষান্তরে সে ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। সুদের হার বেশি বলে বোঝাটা এমনিতেই বেশি। এমনকি এসব প্রতিষ্ঠান যারা তৃণমূলে ক্ষুদ্রঋণ দিচ্ছে, তারা অনেকটা জোর করে প্রভাবিত করে ঋণ দিচ্ছে। ফলে, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার জন্য, স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য হলেও তারা ঋণগ্রস্ত হচ্ছে। যেকোনও দেশ, যখন কোনও ইকোনমিক ‘শক’ এর মধ্য দিয়ে যায়, যেটা তার হাতে নেই, বা তার জানা-বুঝার মধ্যে আছে— উভয়ক্ষেত্রেই তাকে একটা বিপদে পড়তে হয়। কেননা, তার জন্য ইনস্যুরেন্সের ব্যবস্থা নেই। এই জায়গাগুলো যদি আরেকটু গুছিয়ে নিশ্চিত করা যায়, তাহলে তরুণ ব্যবসায়ী গ্রুপের মধ্যে হতাশা বাসা বাঁধবে না এবং ঋণের বোঝা নিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্যও হবে না।’

জীবন চালাতে অপরিকল্পিতভাবে ঋণ নিয়ে সেই ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে যারা হতাশায় ভুগছেন, তাদের মানসিক চিকিৎসার কোনও সুব্যবস্থা নেই উল্লেখ করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এ ধরনের বিপদের মুখে তার করণীয় কী, কীভাবে বের হয়ে আসতে পারে, সেসব মানসিক সহায়তা দেওয়ার কোনও সুব্যবস্থা নেই। তার ওপর আছে সামাজিক লোকলজ্জার চাপ। দুই ধরনের চাপ সামাল না দিতে পেরে, সহজ উপায় হিসেবে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এদের মানসিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’