হিলারিপাড়ায় বাল্যবিয়ে ‘অনিবার্য নিয়তি’

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নের মহিষাহাটি গ্রামের আলোচিত এলাকা ঋষিপাড়া। এখানে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের স্ত্রী সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। হিলারি দেশে ফিরে যাওয়ার পর ঋষিপাড়ার নামকরণ করা হয় ‘হিলারি আদর্শপাড়া’। এখন সবাই বলে হিলারিপাড়া। পাড়ার অধিকাংশ পরিবার দরিদ্র। এখানে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও গত দুই যুগেও প্রতিষ্ঠা হয়নি কোনও মাধ্যমিক বিদ্যালয় কিংবা কলেজ। দারিদ্র্য এবং পারিবারিক নানা টানাপোড়েনের কারণে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় পাড়ার মেয়েদের। বাল্যবিয়ে এখানে স্বাভাবিক নিয়ম; কিশোরীদের অনিবার্য নিয়তি। যুগ যুগ ধরে চলছে এই রীতি, নেই কোনও পরিবর্তন।

১৯৯৫ সালে ঋষিপাড়ায় এসেছিলেন হিলারি ক্লিনটন। তার সঙ্গে ছিলেন মেয়ে চেলসিয়া ক্লিনটন এবং গ্রামীণ ব্যাংকের তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পরে ঋষিপাড়ার নাম বদলে হয় হিলারিপাড়া। সবাই ভেবেছিল, নামের সঙ্গে পরিবর্তন এবং উন্নত হবে পাড়ার মানুষের জীবনযাত্রা ও রীতিনীতি। দূর হবে প্রচলিত প্রথা, কুসংস্কার, বাল্যবিয়ে, নিরক্ষরতা এবং সামাজিক অস্থিরতা। কমবে দারিদ্র্য, বাড়বে সচেতনতা ও নারী শিক্ষার হার। অথচ ২৮ বছরেও কোনও পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়নি।

পাড়ার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত ঋষি সম্প্রদায়ের মানুষগুলো। সামাজিক অবস্থান, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা আর শিক্ষাহীনতার কারণে পরিবারের মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়; যাকে বলে বাল্যবিয়ে। পাশাপাশি পরিবারের ছেলেদেরও একই অবস্থা। সেইসঙ্গে ছেলেদের অল্প বয়সে উপার্জনমুখীও হতে হয়।

মহিষাহাটি গ্রামের হিলারিপাড়া, বাদেডিহি আর ফুলবাড়ী পাড়ায় ঋষি সম্প্রদায়ের শতাধিক পরিবারের বসবাস। বেশিরভাগ পরিবারের ছেলেরা সেলুনে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বাকিরা জুতা সেলাই, বাঁশ-বেত দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি, রিকশা-ভ্যান ও কৃষিশ্রমিক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করেন। হাতেগোনা দুই-তিন জন সরকারি চাকরি করেন; তাও তৃতীয় কিংবা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে।

১৯৯৫ সালে ঋষিপাড়ায় হিলারি ক্লিনটন, তার মেয়ে চেলসিয়া ক্লিনটন এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূস পাড়ার বাসিন্দাদের কথাবার্তায় তাদের জীবনযাত্রা ও রীতিনীতি ফুটে ওঠে। তাদের কথাবার্তা, চলাফেরা, পোশাক-আশাক দেখে যে কারও মনে হবে নাগরিক সব সুযোগ-সুবিধা ও মৌলিক অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। কোনোদিন তাদের জীবনমানের উন্নয়ন হবে কিনা, তাও জানা নেই পাড়াবাসীর।

জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী ঋষিপাড়ার বাসিন্দা রিকশাচালক কালিদাসের বয়স ৩৫ বছর। বাস্তবে বয়স আরও কম। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে বাঁশ দিয়ে ঝুড়ি-কুলা তৈরি করে জীবন সংগ্রাম শুরু করেন। পরে কৃষিজমিতে দিনমজুরের কাজ করতেন। গত ১০-১১ বছর যশোরে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। স্ত্রী জোসনা দাসের বয়স ৩০ বছর। অন্যের বাসায় কাজ করেন। লেখাপড়া করেননি দুই জনের কেউ। ১৮ বছর আগে তাদের বাল্যবিয়ে হয়েছিল। মৌলিক কিংবা নাগরিক অধিকার কী, জানা নেই তাদের।

হিলারির সঙ্গে তোলা ছবি এখন রয়েছে অনেকের ঘরে এই দম্পতির তিন মেয়েসন্তান। বড় মেয়ে নূপুর দাসের বয়স ১৬। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে বাড়িতে থাকছে। হৃদরোগী হওয়ায় কোনও কাজ করতে পারছে না। দ্বিতীয় মেয়ে বাসনা দাস (১৩) চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। ছোট মেয়ে সুবর্ণা দাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে।

অল্প বয়সে বিয়ে করার প্রসঙ্গে কালিদাস বলেন, ‌‘সেসময় বাবা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলেন। বাবার পাঁচ সন্তানের মধ্যে আমি একমাত্র ছেলে। বাবার ইচ্ছে, মরার আগে ছেলের বউ দেখবেন, তার হাতের রান্না খাবেন। বাবার ইচ্ছে পূরণে আমাকে বিয়ে করতে হয়েছে। যদিও এটাই আমাদের পাড়ার রীতি।’

বর্তমান সময়ের হিলারিপাড়া ঋষিপাড়ার আরেক বাসিন্দা আদুরী রানী দাসের বয়স ৪৫ বছর। স্বামীর নাম অজিত দাস। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে তাদের। অজিত কালীগঞ্জের ধোপাদীতে জুতা সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালান। বড় ছেলে লিটন দাস ভ্যান চালান আর ছোট ছেলে রিপন দাস সেলুনে কাজ করেন। দুই ছেলে বিয়ে করেছেন। তাদের ঘরেও সন্তান আছে। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন ১২ বছর বয়সে। ছোট মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।

পাড়ার ৭০ বছর বয়সী মীনা রানী দাস ২০ বছর আগে স্বামী কেতু দাসকে হারান। ১৬ বছর বয়সে মীনার বিয়ে হয়েছিল। চার মেয়ে ও এক ছেলের জননী। তারই সন্তান কালিদাস সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। একই পাড়ায় বসবাস করেন মীনার বড় মেয়ে পুতুল দাস। তার তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। প্রত্যেকের বিয়ে হয়েছে ১৪-১৫ বছর বয়সে। তাদের ঘরেও সন্তান আছে।

ঋষিপাড়ায় হিলারি ক্লিনটন, চেলসিয়া ক্লিনটন ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস মেজো মেয়ে রূপালীর এক ছেলে ও এক মেয়ে। তাদেরও বিয়ে হয়েছে ১৪-১৫ বছর বয়সে। তৃতীয় মেয়ে সবিতার দুই মেয়ে। এর মধ্যে বড় মেয়ের নাম রাধা রানী। তাকে ১২ বছর বয়সে বিয়ে দিয়েছেন। তার দুই বছরের এক মেয়েসন্তান আছে। স্বামী খোঁজখবর না নেওয়ায় বাবার বাড়িতেই থাকেন রাধা। সবিতার আরেক মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। তবে তাকে বিয়ে দেননি এখনও।

মীনার চতুর্থ মেয়ে ময়না দাসের শ্বশুরবাড়ি যশোরের চুড়ামনকাটি এলাকায়। দুই ছেলে ও এক মেয়ে ময়নার। ছেলেদের বিয়ে হয়েছে ১৪-১৬ বছর বয়সে। তবে ১২ বছরের মেয়ের বিয়ে হয়নি এখনও।

যশোরে রিকশা চালান ঋষিপাড়ার বাসিন্দা দোলন দাস (২৬)। তার বাবা আনন্দ দাস এবং মা মালঞ্চ দাস। পাঁচ ভাইবোনের সংসারে দোলন দ্বিতীয়। ১১ বছর আগে বিয়ে করেন নড়াইলের শম্পা দাসকে। স্বামী-স্ত্রী চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। দুই জনের এটি বাল্যবিয়ে। এই দম্পতির ৯ বছর ও তিন বছরের দুই মেয়েসন্তান আছে। বাল্যবিয়ের বিষয়ে দোলন দাস বলেন, ‘মেয়েদের বয়স ১৫ পার হলে তো পাত্র পাওয়া যায় না। এত বয়সী (১৫ বছর) মেয়েকে বিয়ে করবে কে? কেউ রাজি হলেও মোটা অঙ্কের যৌতুক দাবি করে। ফলে পাড়ার সবাই ১৫ বছরের আগেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন। এটাই পাড়ার প্রথা। যুগ যুগ ধরে চলছে।’

ঋষিপাড়ার বাসিন্দা অসীম দাসের বয়স ২৭ বছর। স্ত্রী শান্তনা দাসের বয়স ২৪ বছর। ২০১৫ সালে তাদের বিয়ে হয়। দুই সন্তানের জনক এই দম্পতি। ছেলের বয়স আট বছর এবং মেয়ের বয়স আট মাস। অসীম পঞ্চম শ্রেণি এবং তার স্ত্রী ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। তারা জানালেন, পাড়ার মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার সময়ে জন্মসনদে বয়স বাড়িয়ে নেওয়া হয়। ফলে পাড়ার বেশিরভাগ মানুষের সঠিক বয়স জানা যায় না।

এই পথেই চলাচল করেন হিলারিপাড়ার বাসিন্দারা সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ১৯টি গ্রাম নিয়ে বারবাজার ইউনিয়ন গঠিত। জনশুমারি অনুযায়ী, ইউনিয়নে জনসংখ্যা ৩০ হাজার ২৮৮ জন। শিক্ষা জরিপ অনুযায়ী, এখানে শিক্ষার হার ৮৫ শতাংশ। তবে বাস্তবতা ভিন্ন।

পাড়ায় বাল্যবিয়ে প্রথা যুগ যুগ ধরে চলছে জানিয়ে মহিষাহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহবুর রহমান বলেন, ‘এই বিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিশু ঋষিপাড়ার। শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ১৬৩ শিশু পড়াশোনা করে। তবে প্রাথমিকের পরে অধিকাংশ পরিবারের মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়। ছেলেদের কাজেকর্মে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’

প্রাথমিকের পরে পড়াশোনা না করার কারণ হিসেবে মাহবুর রহমান বলেন, ‘আর্থিক সংকট, অধিক সন্তান, ধর্মীয় গোঁড়ামি, সচেতনতার অভাব-ই মূল কারণ। ঋষি সম্প্রদায় মনে করে, তাদের সন্তান বিশেষ করে মেয়েদের বয়স বেশি হলে পাপ হবে, পাত্র পাওয়া যায় না। এ জন্য বাল্যবিয়ে দেয়। আবার আর্থিক অনটনের কারণে ছেলেদের উপার্জনের কাজে লাগান। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের কোনও সচেতনতা কার্যক্রমই এই জনগোষ্ঠীকে তাদের প্রাচীন জীবনধারা থেকে বের করতে পারেনি।’

তবে মহিষাহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আগে সব মেয়ের বাল্যবিয়ে হতো। এখন তা কিছুটা কমেছে। আমারা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বুঝিয়েছি, প্রাপ্তবয়স্ক হলে যেন মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়। এরপরও অনেকে গোপনে দিয়ে দিচ্ছেন।’

এ ব্যাপারে কালীগঞ্জ উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক উজ্জ্বল অধিকারী বলেন, ‘ঋষিপাড়ার বাসিন্দারা মূলত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠীর ৯০ শতাংশ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, চিকিৎসাসহ যাবতীয় মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে বাল্যবিয়ে প্রথা তাদের বিশ্বাস। অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণে বেশিরভাগ পরিবার ১২-১৩ বছর বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেয়। একই বয়সী ছেলেদের কাজে-কর্মে লাগায়। সমাজের মানুষ হিসেবে সবারই উচিত, এই জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেওয়া।’

অল্প বয়সে বিয়ে ও নানা কুসংস্কার লালন করছে ঋষি সম্প্রদায় এমনটি জানালেন বারবাজার ডিগ্রি কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হারুন অর রশিদ। তিনি বলেন, ‘দেশের উন্নয়নে সব নারী-পুরুষের সমান অবদান আছে। কোনও জনগোষ্ঠীকে পেছনে রেখে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। ঋষি সম্প্রদায়কে মূলধারায় নিয়ে আসতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও বাল্যবিয়ের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টদের।’

বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসরাত জাহান বলেন, ‘ঋষিপাড়ার বাসিন্দাদের বিষয়ে আলাদাভাবে আমাকে কিছুই জানানো হয়নি। আমি এই উপজেলায় নতুন এসেছি। তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেবো। সেইসঙ্গে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে উদ্যোগ নেবো আমরা। এ নিয়ে প্রচারণা চালাবো।’