সাবেক এমপি আউয়ালের নির্দেশে ২০ হাজার টাকায় খুন হন শাহিন!

রাজধানীর পল্লবীতে শাহিন উদ্দিনের হাত-পা কেটে ফেলার জন্য আসামি সুমন বেপারীকে খরচ বাবদ ২০ হাজার টাকা দেন লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক এমপি ও ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান এম এ আউয়াল। এরপর সুমন বেপারী ও টিটু পরিকল্পনা করে শাহিনকে তার সন্তানের সামনে কুপিয়ে হত্যা করেন। নিজের জমির দখল নির্বিঘ্ন রাখতে আওয়াল এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দেন।

এ ঘটনায় করা হত্যা মামলায় রবিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন আদালতের সাধারণ নিবন্ধন শাখায় সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক মনির হোসেন। চার্জশিটে এসব কথা উল্লেখ করেছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।

তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পল্লবীতে শাহিন উদ্দিন হত্যা মামলায় তদন্তে সত্যতা পেয়ে এম এ আউয়ালসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছি।

চার্জশিটভুক্ত অপর আসামিরা হলেন তাহের, সুপন বেপারী, মুরাদ, টিটু শেখ ওরফে টিটু, গোলাম কিবরিয়া খান, ইব্রাহিম সুমন ওরফে বাওয়া সুমন, শফিকুল ইসলাম ওরফে শফিক, রকি তালুকদার ওরফে রকি, নুর মোহাম্মদ হাসান মোতাইত, ইকবাল হোসেন ওরফে ইকবাল নুর, শরিফ, তৌরিকুল ইসলাম ওরফে ইমন, তুহিন মিয়া, হারুন অর রশীদ ওরফে হারুন ও প্রতীক আহম্মেদ সজীব।

মামলার বাদী আকলিমা বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আইন চলে টাকাপয়সার ওপর। আমার ছেলের সঙ্গে আমাদের আত্মীয় মানোয়ার হোসেন সুমন ছিল। সে তাকে হত্যা করিয়েছে। ডিবি ও পিবিআইকে তার নাম যুক্ত করার জন্য বলেছিলাম। তারা তাকে যুক্ত করেনি। আসামিরা আমাদের এখনও হুমকি দিচ্ছে। বাড়িঘর ভাঙচুর করছে। আমরা এখনও নিরাপদ নই। পিবিআই যে চার্জশিটটা দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে নারাজি দেবো।

প্রকল্পের পিলার ভাঙায় শাহিনের ওপর এমপি আউয়ালের রাগ
মামলার চার্জশিটে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, আলীনগর আবাসিক প্রকল্পের পিলার ভেঙে ফেলায় এম এ আওয়াল ভুক্তভোগী শাহিন উদ্দিনের ওপর রাগ করেন। তার কোম্পানির পিডি (চার্জশিটে অভিযুক্ত আসামি) মোহাম্মদ তাহেরকে দিয়ে মাইনুউদ্দিন ও ভুক্তভোগী শাহিন উদ্দিনের নামে পল্লবী থানায় ২০২১ সালের ২৭ এপ্রিল মামলা করেন। পুলিশ ওই মামলায় মাইনুউদ্দিন ও শাহিন উদ্দিনকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠায়।

শাহিন জেলে থাকা অবস্থায় তার স্ত্রীর বড় ভাই জহির হ্যান্ডেলী প্রোপার্টি ডেভেলপার লিমিটেডের পক্ষে আসামি সুমন বেপারী ও টিটুনকে সঙ্গে নিয়ে মেজর (অব.) মোস্তফা কামালের জমির অর্ধেক বাউন্ডারি দেয়াল ভেঙে ফেলে। এরপর শাহিন ও মাইনুউদ্দিন বেশ কিছুদিন পর জেল থেকে জামিনে বের হয়ে এসে আবার আলীনগর আবাসিক প্রকল্পের ১০ কাঠা জমির বাউন্ডারি দেয়াল ভেঙে ফেলেন। ফলে পিএস সজীব কোম্পানির হয়ে আসামি সুমন বেপারী ও টিটুকে অফিসে আসতে বলে।

ঈদের দুই-তিন দিন আগে আওয়ালের অফিসে বেতন আনার জন্য সুমন বেপারী ও টিটু গেলে সেখানে আসামি মোহামম্মদ তাহের, সাইট ম্যানেজার গোলাম কিবরিয়া খান, জাহির ও সজীবকে একসঙ্গে আওয়ালের রুমে বসা অবস্থায় দেখতে পান শাহিন। এ সময় বিরোধের বিষয়টি সবার উপস্থিতিতে মীমাংসা করে দেওয়া হয়।

এমপি আউয়ালের কাছ থেকে ২০ হাজার নিয়ে ১০ হাজার টাকায় আবারও চুক্তি
তদন্ত কর্মকর্তা চার্জশিটে উল্লেখ করেন, শাহিনের হাত-পা কেটে ফেলার জন্য আসামি এম এ আওয়াল খরচ বাবদ ২০ হাজার টাকা আসামি সুমন বেপারীকে দেন। সুমন আবার রকি নামের একজনকে ডাকে হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য। রকিকে সুমন ১০ হাজার টাকা দেয়।

যে লোকের পিঠে হাত দেবে, তাকে কোপাতে হবে
মামলার চার্জশিটে আরও উল্লেখ করেন, হত্যাকারীরা চায়ের দোকানে বসে ছিল। সুমন বেপারী তাদের বলে, তার কাছে একজন লোক আসবে। সে যে লোকটার পিঠে হাত দেবে, তাকে কোপাতে হবে। সুমন বেপারী এ পরিকল্পনা করে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়।

শাহিনের ছেলেকে চিপস খাওয়ার জন্য ১০ টাকা দেয় সুমন
হত্যাকারীরা যখন নিজ নিজ অবস্থানে ওত পেতে ছিল, তখন বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে শাহিন উদ্দিন তার ছেলে মাশরাফিকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে ঘটনাস্থলের সামনে এসে থামেন। এ সময় সুমন বেপারী কাছেই দাঁড়িয়ে মোবাইল টিপছিল। শাহিনের ছেলে মাশরাফিকে মোটরসাইকেল থেকে কোলে করে নিচে নামিয়ে চিপস খাওয়ার জন্য ১০ টাকা দেয় সুমন। কথা বলতে বলতে সে শাহিনের কাঁধে হাত রেখে অন্য আসামিদের ইশারা করে। পরে তুহিন ও ইমন রাস্তার বিপরীত পাশ থেকে এসে শাহিনের পেছন থেকে হামলা করে।

কোপ খেয়ে শাহিন মোটরসাইকেল থেকে মাটিতে পড়ে যান। বাঁচার জন্য দ্রুত উঠে একটি বাড়ির গ্যারেজের ভেতর ঢুকে পড়েন। গ্যারেজে লুকিয়ে থাকা মানিক ও মুরাদ তাকে আবার কোপায়। শাহীন গ্যারেজ থেকে বের হয়ে এলে সব আসামি তাকে ঘিরে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে।

মামলা
২০২১ সালের ১৬ মে শাহিন উদ্দিন হত্যাকাণ্ডের পর ওই রাতেই নিহতের মা আকলিমা বেগম বাদী হয়ে পল্লবী থানায় সাবেক এমপি আউয়ালসহ ২০ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলায় এম এ আউয়ালকে প্রধান আসামি করা হয়। এ ছাড়া অন্য আসামিরা হলো ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সুমন, মো. আবু তাহের, মুরাদ, মানিক, মনির, শফিক, টিটু, কামরুল, কিবরিয়া, দিপু, আবদুর রাজ্জাক, মরন আলী, লিটন, আবুল, বাইট্যা বাবু, বড় শফিক, কালু ওরফে কালা বাবু, নাটা সুমন ও ইয়াবা বাবু।

মামলার এজাহারে আকলিমা বেগম বলেন, ২০২১ সালের ১৬ মে বিকাল ৪টার দিকে সুমন ও টিটু নামের দুই যুবক শাহিন উদ্দিনকে জমির বিরোধ মেটানো হবে জানিয়ে ফোন করে ডেকে নেয়। শাহিন মোটরসাইকেলে পল্লবীর ডি-ব্লকের ৩১ নম্বর সড়কের ৪০ নম্বর বাসার সামনে গেলে সুমন ও টিটুসহ ১৪ থেকে ১৫ জন মিলে তাকে টেনেহিঁচড়ে ওই বাড়ির গ্যারেজে নিয়ে যায়।

এ সময় শাহিনের ছয় বছর বয়সী ছেলে মাশরাফি গেটের বাইরে ছিল। গ্যারেজে নিয়ে তাকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে আসামিরা। এরপর তাকে ওই গ্যারেজ থেকে বের করে ৩৬ নম্বর বাড়ির সামনে আবার কুপিয়ে ফেলে রেখে চলে যায় তারা। পরে ঘটনাস্থলেই শাহিনের মৃত্যু হয়।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এ মামলায় লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক এমপি ও ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান এম এ আউয়ালসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক সৈয়দ ইফতেখার হোসেন।

ওই অভিযোগপত্রের আসামিরা হলো সুমন ব্যাপারী, টিটু, কিবরিয়া, মুরাদ হোসেন, আবু তাহের, ইব্রাহিম সুমন, রকি তালুকদার, শফিকুল ইসলাম, তুহিন মিয়া, হারুন অর রশীদ, তারিকুল ইসলাম, নুর মোহাম্মদ, হাসান ও ইকবাল হোসেন। সুমন ও শফিকুল ছাড়া বাকি ১৩ আসামি কারাগারে আছে। তাদের মধ্যে ৯ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

শাহিন উদ্দিনের মায়ের নারাজির আবেদনে আদালত পিবিআইকে মামলাটি পুনরায় তদন্ত করে প্রতিবেদন জমার নির্দেশ দেন।

সম্পূরক অভিযোগপত্রের বিষয়ে যা বললেন আউয়াল
সম্পূরক অভিযোগপত্রে আবারও এমপি আওয়ালের নাম উঠে আসার বিষয়ে জানতে চাইলে আউয়াল রবিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রাতে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন তিনি। কারা কী ধরনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে, তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ বিষয়ে তিনি আদালতে যাবেন।

হত্যা মামলায় অভিযুক্ত আসামি হয়েও রাজনৈতিক দলের চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই সংসদ সদস্য বলেন, চেয়ারম্যান হিসেবে আমি রয়েছি। আজ আমাদের মিটিং হয়েছে। জোটের অন্য নেতারা আমার পাশে রয়েছেন। সব নেতা আমার প্রতি আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন, এই ষড়যন্ত্র চক্রান্ত রুখে দেওয়ার জন্য তারাও আমার সঙ্গে আছেন।

আরও পড়ুন- সাবেক এমপি আউয়ালসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক চার্জশিট