সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়তে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে: জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাপী নানা সংকট মোকাবিলায় সব রাষ্ট্রকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সবার জন্য নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ এবং টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য অভিন্ন সঙ্কট মোকাবিলায় আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এ জন্য, আমাদের অবশ্যই বিভাজন, সঙ্কীর্ণতা ও বিচ্ছিন্নতার বিপরীতে একতা, সহমর্মিতা ও বহুপাক্ষিকতা বেছে নিতে হবে। শান্তি ও টেকসই সমৃদ্ধি অর্জনের উদ্দেশ্যে আমাদের অবশ্যই সুবিচার, ন্যায় ও ন্যায্যতার নীতি অনুসরণ করতে হবে, যার ভিত্তি হবে জাতিসংঘ সনদ এবং ২০৩০ এজেন্ডা।’

প্রধানমন্ত্রী শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘ সদর দফতরের জেনারেল অ্যাসেম্বলি হলে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৮তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে এসব কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বক্তব্যের শুরুতেই বলেন, ‘এ বছর সাধারণ পরিষদের সাধারণ বিতর্কের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, “আস্থার পুনর্নির্মাণ এবং বিশ্বব্যাপী সংহতির পুনরুজ্জীবন: আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা আরও জোরদার করে ২০৩০ উন্নয়ন কর্মসূচি এবং এর আওতাধীন টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যসমূহ অর্জনের মাধ্যমে সবার জন্য শান্তি, সমৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ।” আমি মনে করি, বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা ও জটিলতার প্রেক্ষাপটে এবারের প্রতিপাদ্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।’

বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আস্থাহীনতার কারণে সৃষ্ট সংকট এবং তা থেকে উত্তরণের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দক্ষতা ও বৈধতা নিয়ে মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। এর ফলে একটা শান্তিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে অর্জিত সাফল্য ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

‘করোনা মহামারি ও জলবায়ু সঙ্কটের প্রভাব এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্য, অর্থায়ন এবং জ্বালানি নিরাপত্তার ওপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উন্নয়ন-লক্ষ্যসমূহ অর্জনে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে।

‘জটিল এই সন্ধিক্ষণে বৈশ্বিক সংহতি রক্ষার্থে আস্থার পুনর্নির্মাণ এবং পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে আপনার আহ্বান আমাকে এই পরিষদে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭৪ সালের ভাষণের একটি বিশেষ উক্তির কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি বলেছিলেন, ‘‘সাম্প্রতিককালে গোটা বিশ্বে যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে একটি ন্যায়সঙ্গত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে আমাদের আরও ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত…। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে আমাদের মধ্যে মানবিক ঐক্যবোধ-ভ্রাতৃত্ববোধের পুনর্জাগরণ। পারস্পরিক নির্ভরশীলতার স্বীকৃতিই কেবল বর্তমান সমস্যার যুক্তিসঙ্গত সমাধান ঘটাতে সক্ষম। বর্তমান দুর্যোগ কাটাতে হলে অবিলম্বে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা দরকার।”

‘এ প্রসঙ্গে, আগামী বছর “সামিট অফ দ্য ফিউচার” আহ্বান করার উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই। আশা করছি, এই প্রক্রিয়াটি ২০৩০ উন্নয়ন কর্মসূচি অর্জনের জন্য আমাদের প্রচেষ্টার পরিপূরক হিসেবে ভূমিকা পালন করবে।

প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের টেকসই উন্নয়নের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের বাস্তব রূপ দিতে আমরা মানুষের কল্যাণে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও আধুনিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক বিনিয়োগ করেছি। তার দেখানো পথে বাস্তবমুখী নীতিগ্রহণ, সুদূরপ্রসারী চিন্তা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হতে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে পেরেছি। আমরা দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালের ৪১.৫ থেকে ২০২২ সালে ১৮.৭ শতাংশে এবং চরম দারিদ্র্যের হার ২৫.১ শতাংশ থেকে ৫.৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছি।

‘সহাস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে বাংলাদেশের সাফল্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে আমরা এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) অর্জনে অবিচলিত অগ্রগতি সাধন করেছি। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এ ক্ষেত্রে গুরুতর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। করোনাভাইরাস, বিভিন্ন মানবসৃষ্ট সংকট এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় চ্যালেঞ্জগুলোকে বহুগুণে জটিল করেছে। সে কারণে, এই বছর জাতিসংঘ এসডিজি সম্মেলনের সফল আয়োজন এবং এতে গৃহীত রাজনৈতিক ঘোষণাকে আমরা স্বাগত জানাই। কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও আমরা বিশ্বাস করি, এই রাজনৈতিক ঘোষণা ২০৩০ উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নকে ত্বরান্বিত করবে।

তিনি উন্নয়নশীল দেশগুলোর আর্থিক সংকটের সমাধানের বিষয়ে বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এসডিজি অর্জনের ক্ষেত্রে অর্থায়ন গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় যে, বিদ্যমান আন্তর্জাতিক আর্থিক অবকাঠামো লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে যেমন সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তেমনি এটি সঙ্কটের সময় উন্নয়নশীল দেশগুলোর আর্থিক চাহিদা মেটাতেও সক্ষম নয়।

‘আজ এমন একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক অবকাঠামো আমাদের জরুরিভাবে প্রয়োজন যা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বিশেষ ছাড়ে, কম খরচে, কম সুদে এবং ন্যূনতম শর্তে অর্থ সংগ্রহে সহায়তা করবে। তা ছাড়া, জরুরি অবস্থা এবং দুর্যোগের সময় আইএমএফের এসডিআর তহবিলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ন্যায়সঙ্গত প্রবেশাধিকার থাকতে হবে। সমস্ত ঋণ ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংক্রান্ত বিশেষ বিধান অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। ৫০০ বিলিয়ন ডলারের একটি প্রণোদনা প্যাকেজ প্রস্তাবনার জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবকে আমরা আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। আমরা এই প্রস্তাবনার দ্রুত বাস্তবায়ন দাবি করছি।’

তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারি এবং মহামারি-পরবর্তী সময়ে জাতীয় পর্যায়ে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে আমরা বেশ কিছু কঠোর আর্থিক ও নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অন্যদিকে, আমরা সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেছি এবং কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং অন্যান্য দুর্বল খাতে লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা প্রদান করেছি। অসহায় নারী, বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ এবং সমাজের অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিদ্যমান সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সম্প্রসারিত করেছি। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর সুবিধা পাচ্ছেন। চলতি অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে এক লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা (প্রায় ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ বছর, আমরা সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছি। ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী যেকোনও নাগরিক এই পেনশন সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন।’

শেখ হাসিনা নারীর প্রতি বৈষম্য অবসানে নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে বলেন, ‘এসডিজি অর্জনে আমরা নারীর প্রতি বৈষম্যের অবসানকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছি।  নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নারীর ক্ষমতায়ন এবং লিঙ্গসমতা নিশ্চিতকরণ ও প্রত্যাশা পূরণে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা নারী শিক্ষাসহ সার্বিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি। ২০১০ সাল থেকে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করা হচ্ছে। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যায় পর্যন্ত প্রায় ২ কোটি ৫৩ লাখ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি, বৃত্তি এবং এককালীন অনুদান দেওয়া হচ্ছে। তাদের অর্ধেকেরও বেশি নারী।

‘আমাদের জাতীয় বাজেটের মোট ৩০ শতাংশ নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা সরকারের শীর্ষ থেকে সর্বনিম্ন, সব স্তরে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেছি। আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিটি খাতে ৫০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়েছি। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমরা উপযুক্ত আইন প্রণয়ন ও তাদের যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ, নারীর প্রতি সহিংসতা, নারী পাচার এবং অন্যান্য অপরাধ নিরসনের জন্য কাজ করছি। আমরা নারীর অগ্রগতির জন্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ‘প্ল্যাটফর্ম ফর উইমেন লিডার’-এর মাধ্যমে সব আন্তর্জাতিক উদ্যোগের সমর্থন করছি।’

জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় সরকারের  ‘বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনের ০.৪৭%-এরও কম অবদান রাখলেও বাংলাদেশ জলবায়ুজনিত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য মারাত্মক হুমকি। এর সমাধানের লক্ষ্যে জরুরি, সাহসী এবং উচ্চাভিলাষী সম্মিলিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।

‘বাংলাদেশ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও সংরক্ষণ এবং জলবায়ু-সহনশীল টেকসই উন্নয়নের পথ অনুসরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্যারিস চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ সবুজ উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বল্প-কার্বন নির্গমন কৌশল প্রণয়ন করছে। 

‘আমরা জলবায়ু অভিযোজনের জন্য ২০০৯ সালে “বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড” প্রতিষ্ঠা করেছি এবং আমাদের নিজস্ব সম্পদ থেকে এই তহবিলে এ পর্যন্ত ৪৮০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছি।

‘জলবায়ু অভিযোজন এবং প্রশমনের লক্ষ্যে সমুদ্র উপকূলে বাঁধ, সাইক্লোন শেল্টার, গ্রিন বেল্ট এবং বৃক্ষরোপণ করা হচ্ছে। আমরা কক্সবাজারে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। সেখানে ৪ হাজার ৪০৯টি উদ্বাস্তু পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাসহ ১৩৯টি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের জন্য আমার সরকারের যুগান্তকারী উদ্যোগ “আশ্রয়ণ” প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত প্রায় ৮ লাখ ৪০ হাজার পরিবারের ৫০ লাখ মানুষকে বিনামূল্যে ঘর দেওয়া হয়েছে।

‘আমরা ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’ বাস্তবায়ন করছি। এর লক্ষ্য হলো, সমন্বিত ব-দ্বীপ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি নিরাপদ, জলবায়ু সহনশীল এবং সমৃদ্ধ ডেল্টা অর্জন। সরকার “মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা” গ্রহণ করেছে। আমরা ধীরে ধীরে একটি জলবায়ুর ঝুঁকিপূর্ণ দেশ থেকে জলবায়ু সহনশীল দেশে পরিণত হতে কাজ করছি। বাংলাদেশের ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ সোলার হোম সিস্টেম ব্যবহার করছে। আমরা আরও টেকসই শক্তির মিশ্রণের জন্য কাজ করছি। আমরা আশা করি, ২০৪১ সালের মধ্যে আমাদের শক্তির ৪০% পুনঃনবায়নযোগ্য উৎস থেকে পাওয়া যাবে।

‘আমরা প্রধান কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলোকে উচ্চাভিলাষী এনডিসিএস গ্রহণ ও বাস্তবায়নের আহ্বান জানাই। উন্নত দেশগুলোকে অবশ্যই ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে। জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশের উন্নয়ন চাহিদার কথা বিবেচনা করতে হবে। আমরা ২৭তম জলবায়ু সম্মেলনে গৃহীত ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত তহবিলের জরুরি বাস্তবায়ন চাই। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা, লবণাক্ততা, নদীক্ষয়, বন্যা ও খরা-জনিত কারণে জলবায়ু-অভিবাসীদের দায়িত্ব ভাগাভাগির ক্ষেত্রে আমি আন্তর্জাতিক সংহতির আহ্বান জানাই।’

বিগত কয়েক বছরের আন্তঃসংযুক্ত সংকটগুলো বিশ্বব্যাপী খাদ্য, জ্বালানি এবং পণ্য মূল্য বৃদ্ধি করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জ্বালানি ও খাদ্য আমদানিকারক দেশ হিসেবে আমাদের আমদানি বিল উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, যা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, আমরা প্রতিটি মানুষের জন্য খাদ্য নিশ্চিত করেছি। আমরা নিম্ন আয়ের এক কোটি মানুষকে সাশ্রয়ী দামে চাল ও অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করছি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি। আমি আমাদের জনগণকে নিজেদের খাদ্য উৎপাদন করতে এবং কোনও জমি অনাবাদি না রাখার আহ্বান জানিয়েছি। আমাদের বিজ্ঞানীরা খরা, লবণাক্ততা, জলমগ্নতাসহ বিরূপ আবহাওয়া উপযোগী ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছেন।

২০২২ সালে গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপ গঠন এবং এর মাধ্যমে বৈশ্বিক খাদ্য, শক্তি এবং অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলায় প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে বিভিন্নমুখী সমাধান প্রদানের জন্য আমি জাতিসংঘ মহাসচিবকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই। খাদ্যপণ্য রফতানি এবং সরবরাহ শৃঙ্খলে বিদ্যমান সমস্যাসমূহের টেকসই সমাধান নিশ্চিত করার জন্য এই গ্রুপের অন্যতম চ্যাম্পিয়ন হিসেবে আমি সব সময়ই জোর দিয়েছি।

তিনি বলেন, ‘আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যে “ব্ল্যাক সি গ্রেইন ইনিশিয়েটিভ” অকার্যকর হয় পড়েছে এবং এ ব্যবস্থার দ্রুত পুনরুদ্ধারের জন্য আমি সংশ্লিষ্ট সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি। এ ছাড়াও, আমাদের মতো দেশগুলোর জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে সারের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। তা ছাড়া, উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণের লক্ষ্যে হিমাগার নির্মাণের জন্য আমাদের বৈশ্বিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। আমি জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য আঞ্চলিক “খাদ্য ব্যাংক” চালু করার প্রস্তাব করছি। আমাদের অবশ্যই জলবায়ু-সহনশীল ফসলের গবেষণায় একে অপরকে সহযোগিতা করতে হবে।’

আগামী দিনের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভিশন ২০৪১-এর আওতায় ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে আমার সরকার বিপুল বিনিয়োগ করেছে এবং এর মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশকে এমন একটি উচ্চ আয়ের, দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত দেশে পরিণত করতে চাই যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার এবং নিত্য নতুন উদ্ভাবনের পথ উন্মুক্ত করবে। সে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন, লিঙ্গসমতা নিশ্চিতকরণ এবং পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রেখে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতির আধুনিকীকরণ করা হয়েছে।

‘বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল প্রযুক্তি যেমন বহুবিধ সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণে সহায়তা করছে, তেমনি তা আবার বহুবিধ আন্তঃরাষ্ট্রীয় এবং অন্তঃরাষ্ট্রীয় বৈষম্য সৃষ্টির মাধ্যমে বিদ্যমান বিভেদসমূহকে গভীরতর করছে। টেকসই প্রযুক্তির সমতাভিত্তিক প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা গেলে তা টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিপুলভাবে সহায়ক হবে।

আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দক্ষিণ-দক্ষিণ এবং ত্রিপাক্ষিক সহযোগিতার মাধ্যমে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসার এবং এর সুফলগুলোর সমতাভিত্তিক বণ্টন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।’ 

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ২০২৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে অন্তর্ভুক্ত হবে। আমি বিশ্বাস করি, বর্তমান বৈশ্বিক সংকটগুলো আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। তবুও, উন্নয়ন সহযোগী এবং উন্নত দেশগুলোকে আমাদের এ অগ্রযাত্রায় সহযোগিতা অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানাচ্ছি; যা স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় আমাদের জন্য সহায়ক হবে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য প্রযোজ্য বিশেষ সুবিধাগুলো আমাদের প্রয়োজনীয় ব্যাপ্তিকাল মোতাবেক প্রদান করার জন্য আমি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্যদের প্রতি  আহ্বান জানাচ্ছি।    

‘এ বছরের মার্চ মাসে কাতারের দোহাতে অনুষ্ঠিত এলডিসি-৫ সম্মেলনে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য অপেক্ষমাণ দেশগুলোকে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। আমি জাতিসংঘ এবং উন্নয়ন সহযোগীদের দোহা কর্মসূচির সম্পূর্ণ ও কার্যকর বাস্তবায়নের আহ্বান জানাচ্ছি।’

নিরাপদ অভিবাসনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, ‘নিরাপদ, সুশৃঙ্খল ও নিয়মিত অভিবাসনের জন্য প্রণীত আন্তর্জাতিক কমপ্যাক্টের একজন প্রবক্তা হিসেবে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই কমপ্যাক্টের পূর্ণ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পুনরায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। গত বছর অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক অভিবাসন পর্যালোচনা ফোরামের ফলাফলের পূর্ণ বাস্তবায়নের ওপর আমরা বিশেষ গুরুত্বারোপ করছি।’

স্বাস্থ্যসেবা প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণের জন্য কিছু ন্যূনতম মানদণ্ড স্থাপনের ধারণার প্রশংসা করি। এসব লক্ষ্য অর্জনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা যেমন– পর্যাপ্ত অর্থায়ন, প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং উত্তম চর্চাগুলো বিনিময় নিশ্চিত করতে হবে।

‘বাংলাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দিতে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছি। বাংলাদেশের এই সাফল্য এই সাধারণ পরিষদ দ্বারা স্বীকৃত এবং প্রশংসিত হয়েছে। অনুরূপ আর্থ-সামাজিক অবস্থার অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলো আমাদের এই মডেল অনুকরণ করতে পারে।’   

সমুদ্র সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আইনের বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সমুদ্রসীমার শান্তিপূর্ণ সমাধানের পর সুনীল অর্থনীতি বাংলাদেশের উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। আমরা বিশ্বাস করি, সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহারকে কাজে লাগানোর জন্য সমুদ্রের আইন সম্পর্কিত জাতিসংঘ কনভেনশনের বিধানগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন আবশ্যক।  

‘একদিন আগে, আমি জাতিসংঘের সাগর সম্পর্কিত আইন অনুযায়ী দেশগুলোর জাতীয় অধিকারভুক্ত এলাকার বাইরে সামুদ্রিক জৈব বৈচিত্র্যের সংরক্ষণ এবং টেকসই ব্যবহারের জন্য বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি অফ এরিয়াস বিয়ন্ড ন্যাশনাল জুরিসডিকশন-বিবিএনজি চুক্তি সই করেছি। বাংলাদেশ সম্প্রতি তার “ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক” প্রকাশ করেছে, যেখানে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই এবং সহযোগিতার মাধ্যমে সমুদ্রপথ এবং সামুদ্রিক সম্পদের ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।’  

অস্ত্রের প্রসারণ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন ‘সর্বজনীন ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের প্রতি বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি পূর্ণাঙ্গ ও অবিচল। আমরা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ সব আন্তর্জাতিক নিরস্ত্রীকরণ এবং পারমাণবিক অস্ত্রসহ অন্যান্য অস্ত্রের প্রসারণ বন্ধ বিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষর করেছি। আমরা অনতিবিলম্বে আন্তর্জাতিক নিরস্ত্রীকরণ এবং অস্ত্রের প্রসারণ বন্ধ বিষয়ক চুক্তিসমূহের পূর্ণ বাস্তবায়ন চাই।’ 

তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে আমাদের অবদান বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি আমাদের অঙ্গীকারেরই বহিঃপ্রকাশ। এখন পর্যন্ত এক লাখ ৮৮ হাজার বাংলাদেশি নারী ও পুরুষ ৪০টি দেশে ৫৫টি শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা পেশাগত দক্ষতা এবং কাজের জন্য সমাদৃত।

জাতিসংঘ শান্তি বিনির্মাণ কমিশনে নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে এবং নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা সংঘাত-পরবর্তী পুনর্গঠন প্রচেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছি। জাতিসংঘের প্রতিরোধ কর্মসূচি বাস্তবায়নে জাতিসংঘ শান্তি বিনির্মাণ কমিশনের কার্যক্রমকে আমরা পুরোপুরি সমর্থন করি।’