Birendra Krishna Bhadra: লিখতে ভালোবাসতেন, তবে ঠাকুরঘরের ছায়া মাড়াতেন না! কেমন ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র

মহালয়া বলতেই অনেকেই বেতারের একটি বিশেষ অনু্ষ্ঠানকে বোঝেন। সেই অনুষ্ঠানের প্রথম সম্প্রচারের পরে কেটে গিয়েছে ৯৩টা বছর। আসলে ‘মহালয়া’ একটি তিথি। যেখানে পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনা হয়। তর্পণের মধ্য়ে দিয়ে সূচনা হয় শারদোৎসবের। বাঙালির মাঝে এই দিনটি উৎসবের ঘরে ঢোকার চৌকাঠ। আর ওই বিশেষ অনুষ্ঠানের নেপথ্যে যে নামটি রয়েছে তা কারও অজানা নয়। তিনি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। বাণী কুমারের রচনায়, পঙ্কজ মল্লিকের সুরে ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণের স্তোত্রপাঠে মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠান প্রবাদপ্রতিম হয়ে উঠেছে।

ব্যক্তিগত জীবনে কেমন ছিলেন বাঙালির প্রিয় কণ্ঠস্বরের অধিকারী মানুষটি? বীরেন্দ্রকৃষ্ণের বসত ভিটায় এখন তাঁর দিদি, নাতি নাতনি ও ভাইরা থাকেন। নাতনি মন্দিরা ভদ্র চক্রবর্তীর স্মৃতি উস্কে দেয় জমিয়ে খাওয়াদাওয়ার মুহূর্তগুলো। ‘দাদু বেঁচে থাকতে রেডিয়োর শিল্পীরা এই দিন বাড়িতে আসতেন। জমিয়ে হত খাওয়া দাওয়া। যতদিন শয্যাশায়ী হননি, নিজের ঘরে সবার সঙ্গে বসেই অনুষ্ঠান শুনতেন। কখনও আবার আকাশবাণীর অফিসে চলে যেতেন। এখন আগের মতো তাঁর ঘরে সবাই মিলে শোনা না হলেও প্রত্যেকের নিজেদের ঘরে অনুষ্ঠানটি শোনেন। তাঁর ঘরও সাজিয়ে রাখা হয়েছে ঠিক আগের মতোই। খাট, ব্যবহৃত আসবাব, টেবিল, যে রেডিওতে নিজের সৃষ্টি শুনতেন, সেটাও রাখা আছে একই ভাবে। অনেকেই তাঁর মূর্তিতে এই দিন মাল্যদান করতে আসেন।’

শোনা যায় তিনি নাকি স্তোত্রপাঠ করার সময় পট্টবস্ত্র পরে ধুপ দীপ জেলে তবেই বসতেন। বাড়িতে পুজো হলে মন্ত্রোচ্চারণের দায়িত্ব নিতেন। তবে মন্দিরা জানিয়েছেন দাদু কোনওদিনই পুজো বা ঠাকুরঘরের ছায়াও মাড়াতেন না। সেখানে ধুপ দীপ জ্বালিয়ে আরাধনায় বসা তো অসম্ভব ব্যাপার।

১৯৭৬ সালে মহালয়ার ভোরে উত্তম কুমারের স্তোত্রপাঠে দুর্গা দুর্গতিহারিণী সম্প্রচারিত হয়েছিল, বীরেন্দ্রকৃষ্ণের অনুষ্ঠানের পরিবর্তে। সেই নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি। বীরেনবাবুর কী প্রতিক্রিয়া ছিল? ‘দাদু বরাবরই খুব শান্ত, ঠান্ডা মাথার মানুষ। তিনি রেগে যাননি বা উত্তেজিত হননি। শুধু জানিয়েছিলেন, ভালো তো! নতুন কিছু মানুষের পছন্দ হলে তো ভালোই। এমনকি স্বয়ং উত্তম কুমার এসে দাদুকে অনুষ্ঠান শোনার অনুরোধ করে গিয়েছিলেন।’ জানালেন মন্দিরা। যদিও মানুষ মেনে নেননি কণ্ঠের বদল। তুমুল বিক্ষোভ হয়। বাধ্য হয়ে সেই বছরই মহাষষ্ঠীর দিন সকালবেলায় পুনরায় সম্প্রচারিত হয় মহিষাসুরমর্দিনী।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কাছে ‘হেরে গিয়েছিলেন’ উত্তম কুমার

বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র নামটার সঙ্গে নাতনির মনে কেমন স্মৃতি রয়েছে? ‘যখন থেকে দাদুকে দেখছি, ততদিনে উনি পৌঁছে গেছেন বার্ধক্যের সীমায়। বাড়িতে থাকতেন। অনুষ্ঠান কম করতেন। তবে লেখালেখিতে ছেদ পড়েনি কোনওদিন। আমাদের মাঝে মাঝে পড়েও শোনাতেন। শেষ বয়সে নিজে হাতে ওঁর মুখে জল দিয়েছি। এক সময় চিনতেও পারতেন না কাছের মানুষগুলোকে।’ গলায় বিষাদের সুর দাদুর কথা মনে করে।

১৯৯১ সালের ৪ নভেম্বর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র অমৃতলোকে যাত্রা করেন। বেতারে আক্ষরিক অর্থে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। কিন্তু বেতার কি তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান দিতে পেরেছে? তখন স্টাফ আর্টিস্টদের পেনশন-গ্র্যাচুয়িটির ব্যবস্থা ছিল না। প্রভিডেন্ট ফান্ডের সামান্য কয়েকটি টাকা নিয়ে অবসর নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রভারতীতে বেতার-নাটক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন কিছু দিন। শিল্পী রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে কলকাতা ও অন্যত্র শ্রীরামকৃষ্ণ ও মহাভারত বিষয়ে পাঠ-গান করতেন। সামান্য অর্থের বিনিময়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হতেন। এমনকি প্রতিমার আবরণ উন্মোচনও করতেন!

শেষ বয়সে একাধিক সাক্ষাৎকারে ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে অভিমান, হতাশা | বার বার বলতেন ‘ভাবতে পারিনি সবাই আমাকে ভুলে যাবে…’ তবে নিজেই বলে গিয়েছেন, ‘আমাকে ভুলে গেলেও বছরে এক বার সেই দিনটিতে স্মরণ করবেই করবে। তাতেই আমার তৃপ্তি।’ আজ সেই দিন। যে দিন তাঁর কথা মনে না পড়লে বাঙালির উৎসব ঠিকমতো শুরু হয় না।