আনন্দের শহরে ‘আনন্দ’ ফিরুক

পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা। এই শহরকে ‘সিটি অব জয়’ অর্থাৎ আনন্দের শহর বলা হয়ে থাকে। বিখ্যাত লেখক দোমিনিক লাপিয়ের কলকাতাকে নিয়ে যে বইটি লিখেছিলেন তার নাম ছিল ‘সিটি অব জয়’। লাপিয়ে কলকাতা শহরে বহুদিন ধরে বাস করে এমন উপলব্দি করেছিলেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই কলকাতা মোটেও আনন্দের শহর নয়। এই শহর হলো অভাবের শহর, কান্নার শহর! এখানে নোংরা বস্তিতে, ধূলোমাখা পথের পাশে যে সকল গরিব মানুষ বাস করেন, তারা নিরন্তর সংগ্রাম করে যান কেবল বেঁচে থাকার জন্য। এই শহরের সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ও সমর্থকদের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

দোমিনিক লাপিয়ের তার লেখায় সেই সব হতভাগ্যদের কথা বলার চেষ্টা করেছেন। যাদের কষ্টকর সংগ্রাম একটু সুখের জন্য, একটু আনন্দের জন্য। যা তারা কখনও পায়, কখনও বা পায় না। তবুও চেষ্টা চালিয়ে যায় জীবনভর। ঠিক এখানেই তাদের আনন্দ। সাকিব আল হাসানের দলটিও তেমনই। লম্বা কোচিং স্টাফ সঙ্গে নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করেও এই দলটি সাফল্যের দেখা পাচ্ছে না। বাংলাদেশের দর্শকরাও আনন্দ নিয়ে খেলা দেখতে বসে হতাশ হচ্ছেন, দুঃখ পাচ্ছেন। সেই তারাই আবার প্রত্যাশা নিয়ে দলকে সমর্থন জানাতে মাঠে যাচ্ছেন। দোমিনিক লাপিয়ের তার লেখায় যেভাবে লিখেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট যেন তারই প্রতিচ্ছবি।

শনিবার (২৮ অক্টোবর) আনন্দের শহরে ক্রিকেটের নন্দনকানন ইডেন গার্ডেন্সে ফিরছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। সবগুলো ভেন্যুতে কম বেশি দলগুলো তাদের ম্যাচ খেলেছে। অপেক্ষায় ছিল ইডেন। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর ফুরিয়েছে। বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডস ম্যাচ দিয়ে ইডেন গার্ডেন্সে বিশ্বকাপ ফিরছে। তবে আনন্দের শহরে ক্রিকেট নিয়ে কোনও আনন্দ নেই, নেই আবেগ ভালোবাসার কোনও মিশ্রণ। ম্যাচ শুরুর একদিন আগেও শহরে নেই কোনও আমেজ। স্টেডিয়ামের বাইরেও গুটি কয়েক নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকাদের দেখে হয়তো মনে হতে পারে স্টেডিয়ামে কিছু একটা হচ্ছে। এর বাইরে পুরো শহর যেন ঘুমন্ত। বিশ্বকাপ ঘিরে কারও মধ্যে নেই কোনও উন্মাদনা। তবুও চলছে স্টেডিয়ামকে রঙিন চকচক করে দর্শকদের আগ্রহ তৈরি করার চেষ্টা। সেই চেষ্টায় অবশ্য পুরোপুরি সফল কলকাতা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন। এখন দেখার অপেক্ষা আনন্দের শহরে, বাংলাদেশ আনন্দ নিয়ে আসতে পারে কিনা।

দীর্ঘদিন ধরে কলকাতায় টেক্সি চালাচ্ছেন অমিতাভ। এখানে বিশ্বকাপের উন্মাদনা না থাকাটা তার কাছে বিস্ময়ের। তবে এবার শুধু কলকাতায় নয়, কোনও ভেন্যুতেই দর্শকদের ক্রিকেট জ্বরে আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে না। ভারত ম্যাচে কিছু সংখ্যক দর্শক থাকলেও বেশিরভাগ ম্যাচেই দর্শক খরা লক্ষ্য করা গেছে।

হারের বৃত্তে আটকে থাকা বাংলাদেশ দল এই মুহুর্তে কঠিন সময় পার করছে। আগের দিন ভ্রমণ ক্লান্তির কারণে অনুশীলন করেনি মুশফিক-মাহমুদউল্লাহরা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কৃত্রিম আলোয় নিজেদের ঝালিয়ে নিয়েছেন লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। ক্রিকেটারদের চোখে-মুখে চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা, যে কোনোভাবেই হোক নন্দনকাননে হারের বৃত্ত ভাঙতে হবে। সেই আশায় ক্রিকেট ভক্তরাও। দল হারের বৃত্তে আটকে থাকলেও বাংলাদেশকে নিয়ে আশায় ক্রিকেটপ্রেমী জনতা। সামাজিক মাধ্যমে দারুণ সংক্রিয় নোমান ও আফজাল। কলকাতায় টাইগারদের দুটি ম্যাচ দেখতে বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। তাদের হাতে টিকিটও ছিল না। তবুও হন্যে হয়ে খুঁজেছেন। ২৪০০ টাকায় ব্ল্যাক মার্কেট থেকে দুটি টিকিট ম্যানেজও করেছেন। তাদের প্রত্যাশা ক্রিকেটের নন্দনকাননে সাকিব আল হাসানরা তাদের মুখে হাসি এনে দিতে পারবেন।

অনেক স্বপ্ন নিয়েই বিশ্বকাপে যাত্রা করেছিল বাংলাদেশ দল। শুরুটা হয়েছিল জয় দিয়েই। কিন্তু সেই জয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষা তো দূরে থাক, পরের চার ম্যাচে সামন্যতম প্রতিরোধও গড়তে পারেনি। বাংলাদেশের আইকনিক সমর্থক টাইগার শোয়েব খ্যাত শোয়েব আলী পুরো বিশ্বকাপজুড়েই দলকে সমর্থন দিতে এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যুতে ছুটে বেড়াচ্ছেন। পুনেতে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে ভারতীয় সমর্থকদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন শোয়েব। তার বাঘের পুতুলটি ছিন্নভিন্ন করে ফেলেন ভারতীয় সমর্থকরা। পুনেতে বাঘের সেই পুতুল কিনতে বিভিন্ন দোকানে হন্যে হয়ে খুঁজেছেন। অবশেষে কলকাতায় এসে তার সেই কাঙ্ক্ষিত বাঘ খুঁজে পেয়েছেন। এটা নিয়েই শনিবার দলকে সমর্থন জানাতে মাঠে থাকবেন।

বাংলা ট্রিবিউনকে শোয়েব বলেছেন, ‘প্রতিটি ভেন্যুতেই আশায় থাকি সাকিব ভাইরা ভালো করবেন, সমর্থক হিসেবে আমাদের সবার চাওয়া তো সেটাই। আশা করি কলকাতার ভেন্যুতে বাংলাদেশ জয়ের নিশানা উড়াবে।’

আনন্দের শহরে বাংলাদেশের খেলার (ওয়ানডে) অভিজ্ঞতা একেবারে কম। ১৯৯০ সালে এশিয়া কাপের একটি ম্যাচ খেলেছিল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। ৭১ রানে হেরে যাওয়া সেই ম্যাচে ৭৮ রান করেছিলেন আতাহার আলী খান, ৩৩ করেছিলেন মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। চলমান বিশ্বকাপে কঠিন সংগ্রাম পেরিয়ে বাংলাদেশ দল আনন্দের শহরে, আনন্দ উপহার দিতে পারবে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।