মহাসমাবেশ সফল করতে বিএনপি-বিরোধী দলগুলোর নানামুখী তৎপরতা

‘সুনির্দিষ্ট জায়গা চাওয়ার পরও যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে সমাবেশের অনুমতি না মিলে, রাজধানীজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়বে। একইসঙ্গে কোথা থেকে বিক্ষোভ শুরু হবে, কোথায় শেষ হবে তার কোনও ঠিক নেই’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর।

বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) রাত আটটার দিকে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন নুর।

তিনি উল্লেখ করেন, ‘বিএনপি নেতাদের সঙ্গে আমাদের এটাই আলাপ হয়েছে—সামনে যদি কামানও আসে, তা মোকাবিলা করেই সামনে এগোতে হবে। রাজপথ থেকেই জয়লাভ করতে হবে।’

শনিবার (২৮ অক্টোবর) মহাসমাবেশ করতে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে নয়া পল্টন ছাড়া অন্য দুটি ভেন্যু প্রস্তাব করার আহ্বান জানালেও বিএনপির পক্ষ থেকে ‘নয়া পল্টনই’ জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে আরও  কয়েকটি জোটকে ডিএমপির দেওয়া চিঠির জবাবে তারাও তাদের নির্ধারিত স্থানের কথা জানিয়ে ডিএমপি কমিশনারকে চিঠি দিয়েছে। এমনকি ক্ষমতাসীন দলও জানিয়েছে—শনিবার দলীয় শান্তি সমাবেশ হবে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটেই।

এ পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে বিরোধীদের মুখোমুখি অবস্থা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিএনপির নেতারা বলছেন, তারা নয়া পল্টনেই সমাবেশ করবেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে অনুমতি না পেলে কী করবেন, তা দলের পক্ষ থেকে কেউই নিশ্চিত করতে পারেননি।

এ বিষয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এসব নিয়ে আমাদের দায়িত্বশীলরা রয়েছেন, তারা বলবেন।’

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ভাষ্য, ‘বিএনপি একটি নির্দিষ্ট স্থান চেয়েছে। আমরা সবাই তা-ই চেয়েছি। যদি সেটা করতে না দেয়, তাহলে সারা ঢাকায় বিক্ষোভ হবে। আমাদের দলের নেতাকর্মীরা সর্বোচ্চ জমায়েতের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সচেষ্ট।’

তিনি বলেন, ‘এই মহাসমাবেশ কোনও দল বা গোষ্ঠীর নয়, এটি গণতন্ত্র রক্ষা ও দেশের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন। সমাবেশের অনুমতি না দেওয়াটা ভুল হবে। পরিস্থিতি এমন হবে যে সরকার ট্যাকেল করতে পারবে না। প্রয়োজনে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে।’

বিএনপির মিডিয়া সেলের শায়রুল কবির খান জানান, শুক্রবার (২৭ অক্টোবর) সকাল ১১টায় সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

দলীয় সূত্র বলছে, সমাবেশের জায়গা নিয়ে বিএনপির কী চিন্তা, সেটি শুক্রবার মির্জা ফখরুলের বক্তব্যে উঠে আসবে। সমাবেশের অনুমতি পেলে বা না পেলে পরবর্তী কী করণীয় সে সম্পর্কেও তিনি বার্তা দেবেন। স্থান পরিবর্তন নিয়েও তিনি কথা বলবেন।

সূত্রের দাবি, সমাবেশের জায়গা নিয়ে প্রশাসন থেকে বাস্তবসম্মত প্রস্তাব দেওয়া হলে বিএনপি তা গ্রহণ করবে। নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে যেভাবে আন্দোলন হয়ে এসেছে, সে বিষয়টিকে কেন্দ্রে রেখেই মহাসমাবেশ বাস্তবায়ন করার পক্ষে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব।

তবে শেষ মুহূর্তে সমাবেশ করতে না দিলে উভয় পক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে চলে যেতে বাধ্য হবে বলে দাবি করেছে সূত্র। এক্ষেত্রে গ্রেফতার হতে পারেন বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা।

বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) রাতে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ জানান, এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে গত তিন দিনে মোট গ্রেফতার করা হয়েছে প্রায় ১২০০ নেতাকর্মীকে। বুধবার থেকে এখন পর্যন্ত মোট গ্রেফতার করা হয়েছে ৩৩০ জনের বেশি নেতাকর্মী এবং মিথ্যা মামলা হয়েছে ১৬টি।

বিএনপির নেতাকর্মীরা গ্রেফতার, আটক হলেও যুগপতে যুক্ত বিরোধী দলগুলোর কোনও নেতাকর্মীর গ্রেফতার বা আটকের খবর পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণঅধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দলের সিনিয়র নেতারা জানান, এখন পর্যন্ত (বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটা) তাদের কোনও গ্রেফতার বা আটক নেই।

বিএনপির সঙ্গে যুগপতে যুক্ত বিভিন্ন দল ও জোটের পক্ষ থেকে ডিএমপিকে সমাবেশের স্থান সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। পাল্টা ডিএমপি সবাইকে ভিন্ন দুটি ভেন্যুর কথা জানিয়ে চিঠি দেওয়ার পর প্রায় সবাই নির্ধারিত স্থানে কর্মসূচি পালনের কথা জানিয়েছে।

যুগপতে যুক্ত দলগুলোর নেতারা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তারা সর্বোচ্চ জমায়েতের চেষ্টা করছেন। ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়তি তৎপরতার মধ্যেই ঢাকায় এসেছেন দলের নেতাকর্মী ও অনুসারীরা।

গণতন্ত্র মঞ্চের সূত্র জানায়, তারা মৎস্য ভবনের সামনে শনিবারের মহাসমাবেশে অন্তত সাত-আট হাজার জমায়েত করার চেষ্টা করছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মঞ্চের নেতা সাইফুল হক বলেন, ‘বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকার আতঙ্ক তৈরি করার চক্রান্ত করছে। ক্ষমতা হারানোর ভয়ে তারা পরিবেশকে গণআতঙ্কে পরিণত করছে। ভয় থেকেই তারা লগি বৈঠা নিয়ে আসার কথা বলছে। সংঘাত ডেকে আনছে। আমরা রাজপথে জনস্রোত নামিয়ে গণজাগরণ তৈরি করতে চাই।’

১২ দলীয় জোটের অন্যতম নেতা শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘আমরা ডিএমপিকে অবহিত করেছি, বিজয়নগর পানির ট্যাংকের ওখানে সমাবেশ করবো।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন। বেশ ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি। আমাদের যতগুলো পকেট আছে, সবগুলো থেকে লোকজন আসবে। নির্বাচনি এলাকা থেকেও লোকজন এসেছে। আশা করি আমরা হাজার-হাজার মানুষের সমাগমের মধ্য দিয়ে মহাসমাবেশ করবো।’

হাজার তিনেক কর্মী জমায়েত করবে বলে জানিয়েছে গণফোরাম ও পিপলস পার্টি।

গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘নটরডেম কলেজের সামনেই আমরা সমাবেশ করবো। এক্ষেত্রে পুলিশকে জানানো হয়েছে। গণফোরামের কোনও নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়নি।’

জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের নেতা ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ জানান, আমরা আমাদের সাধ্যমতো লোকের জমায়েতে মহাসমাবেশ করবো।

বিজয়নগর পানির ট্যাংক সংলগ্ন পল্টন টাওয়ারের সামনে সমাবেশ করা হবে জানিয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘আমরা সমাবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছি। সবসময় কর্মীদের যেমন উপস্থিতি থাকে, এবারের সমাবেশে তেমনটা থাকবে বলে আশা করছি।’

রাশেদ খান আরও বলেন, ‘নতুন করে এখন পর্যন্ত কোনও নেতাকর্মীকে আটকের খবর পাইনি। তবে ২৮ তারিখকে কেন্দ্র করে আমাদের লোকদের গ্রেফতারের পরিকল্পনা করছে বলে জেনেছি।’

শনিবারের সমাবেশে অন্তত হাজারখানেক লোকের জমায়েত করবে এলডিপি। তবে দলটির কেন্দ্রীয় নেতা সালাহউদ্দিন রাজ্জাক দাবি করেন, শনিবার পূর্ব পান্থপথ এলাকায় দলের চেয়ারম্যান অলি আহমদের উপস্থিতিতে অন্তত ১০ হাজার লোকের মহাসমাবেশ করবে এলডিপি।

তিনি জানান, শনিবার সন্ধ্যার আগে আমাদের কর্মসূচি শেষ হবে। সারা দেশের নেতাকর্মীরা এতে যোগ দেবেন।

এনডিএম-এর ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মোমিনুল আমিন বলেন, ‘আমরা সারা দেশ থেকে আমাদের নেতাকর্মীদের ঢাকায় আসার নির্দেশ দিয়েছি এবং ইতোমধ্যে ৩৭টি জেলার নেতাকর্মীরা ঢাকায় অবস্থান করছেন। আশা করছি সহস্রাধিক লোকের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা এই সরকারের বিদায়ের দাবির পক্ষে আমাদের শক্ত অবস্থান জানান দিতে পারবো।’

তিনি উল্লেখ করেন, শনিবার সকাল ১১টায় মালিবাগ মোড়ে “মুক্তির মহাসমাবেশ” আয়োজন করবে এনডিএম।

যুগপতের বাইরে থাকা আমার বাংলাদেশ পার্টিও ২৮ অক্টোবর সমাবেশ ডেকেছে। দলের সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মনজু বলেন, ‘‘সরকারি দলের ধমক-হুমকি ও পুলিশের হয়রানি উপেক্ষা করে এক দফা দাবিতে ঢাকায় ‘গণতন্ত্র সমাবেশ’ করবে এবি পার্টি। আমরা সর্বোচ্চ জমায়েতের মধ্য দিয়ে সমাবেশ করবো।’’

মজিবুর রহমান মন্জু আওয়ামী লগি বৈঠা মোকাবিলায় জাতীয় পতাকা হাতে ২৮ অক্টোবর জনগণকে নির্ভয়ে রাজপথে গণতন্ত্রের স্লোগান তোলার আহ্বান জানান।