Wedding Planning: ৪০ রসগোল্লা সাঁটানো ‘টেনিদা’, কোটি-কোটি টাকার ফোয়ারা; বিয়ে যেন দিল্লির লাড্ডু

ওয়েডিং প্ল্যানার, ম্যারেজ আর্টিস্ট, মেক-আপ আর্টিস্ট, ফটোশ্যুট, বলিউডি পরিবেশ, টাকার বন্য়া ছাড়া বিয়ে তো অর্থহীন।

তালিকাটা হাতে পেয়ে চোখ কপালে উঠে গেল। আসলে এতটাই অবাক হয়েছিলাম যে চোখ কপালে ওঠার মতো ক্লিশে হয়ে যাওয়া বিশেষণ ছাড়া আর কিছু মাথায় এল না। তালিকাটা ওয়োডিং প্ল্যানারের। তাতে বিস্তারে লেখা আছে, বিয়েতে কী অনুষ্ঠান কীভাবে হবে। এখনকার বিবেচনায় আমরা প্রায় প্রস্তর যুগের মানুষ। আমাদের সময় বিয়ের দিন সকালে গায়ে হলুদ, বিকেলে সোজা ছাদনাতলায় বিয়ে। একদিন পর বৌভাত। তখন আলোচনার বিষয় ছিল, পাড়ার নাড়ুদা ৪০ পিস মাছ খাওয়ার পর এক হাঁড়ি দই খেয়ে গোটা চল্লিশেক রসগোল্লা সাঁটিয়ে দিয়েছেন, তাঁকে কেউ টপকাতে পারবে কিনা। তখন পাড়ায়-পাড়ায় এহেন টেনিদারা বিরাজ করতেন। ডায়েটিং কথাটা সাধারণ মানুষের ডিকশনারিতে ছিল না।

তালিকার কথায় ফিরি। অনুষ্ঠানের তালিকাটা ছিল এরকম। প্রি-ওয়েডিং ফোটো শ্যুট (দেশে বা বিদেশে শ্যুট করা ওই ভিডিও বিয়ের পরে দম্পতিরাও দেখেন কিনা সন্দেহ), প্রোপোজ করার অনুষ্ঠান, আইবুড়ো ভাত, সংগীত (ডিজে-সহ), মেহেন্দি, হলদি বা গায়ে-হলুদ (পোশাকের রঙ হলুদ বা বাসন্তী), বিয়ের পোশাকে বর-কনের ফার্স্ট লুক ফটো-অপ, বরযাত্রীদের অনুষ্ঠানস্থলে আসা এবং সেখানে বর আসবে মার্সিডিজে। অন্যরা নিজের মতো গাড়িতে বা বিলাসবহুল বাসে। রিসেপশনের পরের বৌভাত ও মেয়েকে বিদায় দেওয়ার অনুষ্ঠান।

তালিকায় বলা ছিল, অনুষ্ঠানস্থলের কাছে ব্যান্ড পার্টি থাকবে। বরের শর্ত অনুসারে এক ঘণ্টা নাচার পর প্রবেশ। বর যখন ছাদনাতলায় যাবেন, তখন পুরো জায়গাটা অন্ধকার থাকবে। তারপর বরের রাস্তার দুই দিকে শুরু হবে আলোর রোশনাই, কনেও আসবেন একইরকমভাবে। দুজনের উপরে পড়তে থাকবে ফুল। সেই কুসুমাস্তীর্ণ পথে  হাঁটতে হাঁটতে বর ও কনে আসল ছাঁদনাতলায়। প্রতিটি জায়গার আবার আলাদা রং আছে। আমি যে বিয়ের কথা বলছি, সেখানে ছাদনাতলার রং ছিল অফ হোয়াইট ও হালকা মেরুন। সবকিছু সেই রংয়ের। আর যে সে ছাদনাতলা নয়, বলিউডের সিনেমায় যে ধরনের ছাদনাতলা দেখা যায়, সেরকম আর কী।

বর-কনে দাঁড়াতেই তুবড়ির মতো ইলেকট্রিক বাজি শুরু হল। বড় মায়াময়, বড় অপরূপ হয়ে উঠল চারপাশ। পুরোহিত একটু দূরে হাপিত্যেশ করে বসে আছেন, কখন এসব শেষ হয়। বর-কনের বাবা-মা হাসি-হাসি মুখ করে (এতক্ষণ ধরে এইভাবে কী করে হাসা যায় কে জানে) একদিকে দাঁড়ায়ে। কিন্তু যতক্ষণ ফটো ও ভিডিয়ো তোলা শেষ না হচ্ছে, ততক্ষণ তাঁদের ওইভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে হল। আর ফটো ও ভিডিয়ো শ্যুট তো চাট্টিখানি কথা নয়, একবার এইভাবে পোজ দিতে হবে। আরেকবার অন্যদিকে। বর একবার কনের কাঁধে হাত দিয়ে ছবি তুলবে, তো তারপর কনেও বরের কাঁধে হাত রেখে ছবি তুলবে। তারপর প্রায় ভারতনাট্যমের কায়দায় নানা ভঙ্গিতে ছবি ও ভিডিয়ো তোলা হতেই থাকবে। ফটোগ্রাফার ও ভিডিওগ্রাফাররা তো অল্পে সন্তুষ্ট হন না। তাঁরা যে কয়েক লাখ টাকা নিয়েছেন, তা জাস্টিফাই করতে গেলে এসব তো একটু লাগবেই। ক্রিয়েটিভ বিষয় বলে কথা। সময় লাগবে না? কোনওরকমে সেই শ্যুট শেষ হল, শুরু হলো নানা আলোর খেলা। মঞ্চের সঙ্গে আলোকসজ্জাও তো সমান গুরুত্বপূর্ণ।

ওহো, বলতে ভুলে গিয়েছি, বর-কনের ড্রেস করেছেন ডিজাইনাররা। তাঁদের কারিকুরি আবার নির্ভর করে কতটা কড়ি ফেলা হচ্ছে তার উপর। যত বেশি দাম, ততই তার বাহার। যত নামী ডিজাইনার, তত বেশি তার মূল্য। বর-কনের পোশাকের দাম অনায়াসে আমাদের সারা বছরের বেতনের থেকে বেশি। যে পোশাক তাঁরা আর কখনও গায়েও তুলবেন না।

ততক্ষণে ডিজে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। শুরু হয়েছে উদ্দাম গান এবং নাচের ফ্লোরে ঝিকিমিকি আলো। তার সঙ্গে নাচ। অন্যদিকে সুরার ফোয়ারা চলছে।

এভাবেই একটার পর একটা অনুষ্ঠান হতে থাকল। আমি ওই ওয়েডিং প্ল্য়ানারের এক কর্তাকে ধরে জানতে চেয়েছিলাম এই ধরনের বিয়ে কতজন পছন্দ করেন। জবাব এসেছিল, ১০০-র মধ্যে ৯০ জন। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনাকে তো কিছু করতে হবে না। আমরা সব করে দেব। যেরকম টাকা ঢালবেন, সেরকমভাবে বিয়ে হবে।’

আমার মতো আদার ব্যবসায়ীরও মাঝেমধ্যে জাহাজের খোঁজ নিতে ইচ্ছে হয়। তাই জানতে চাই, কত টাকা লাগে এরকম বিয়েতে? জবাব এল, ‘সব অনুষ্ঠান একেবারে থিম অনুযায়ী করতে, অতিথিদের ভালো হোটেলে রেখে চমকপ্রদ আলো ও মঞ্চের ব্যবস্থা করতে গেলে কয়েক কোটি তো বটেই। খুবই সাদামাটা এবং কয়েকটি মাত্র অনুষ্ঠান করলে লাখ ১৫-২০ মধ্য়ে হয়ে যাবে।’

এত টাকা কী করে খরচ করে মানুষ? প্ল্যানারের জবাব, ‘কিছু মানুষের কাছে প্রচুর টাকা আছে. অন্যরা জমায়, ধার করে, জমি বিক্রি করে, যেভাবে হোক টাকা জোগাড় করে।’ মনে পড়ল, দিল্লিতে কিছুদিন আগে হেলিকপ্টারে করে বরের বিয়ে করতে যাওয়ার হিড়িক উঠেছিল। দিল্লি এখন আড়ে-বহরে যতটা পারছে বাড়ছে। সোনার দামে জমি বিক্রি হচ্ছে। সেই জমির মালিকেরা হাতে কোটি-কোটি টাকা পেয়ে যাচ্ছেন। তখন তাঁরা দুটো জিনিস করেন। মার্সিডিজ বা অডি গাড়ি কেনেন এবং হেলিকপ্টার করে বিয়ে করতে যান।

কিন্তু এটা তো অনিত্য বিষয় এবং যে বিয়ের কী গতি হবে তা তো কেউ জানে না, তার জন্য এত খরচ কেন করে মানুষ? ওই প্ল্যানার একটা মোক্ষম কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বলিউডের ছবিতে, সেলিব্রিটি বিয়েতে, ফেসবুক, ইনস্টায় একবার চোখ রাখুন, দেখবেন কীভাবে মানুষের মনে এই আকাঙ্খা ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সবাই পাগলের মতো ছুটছেন।’ 

তিনি খুব গর্ব করে বলেছিলেন, ‘এই কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করার জন্যই তো আমরা আছি। আর একটা কথা ভুলে যাবেন না, বিয়েটাও একটা ইন্ডাস্ট্রি। এর সঙ্গে কত মানুষের রুটি-রুজি যুক্ত। আর বিয়ে হল দিল্লির লাড্ডুর মতো, খেলেও পস্তাবেন, না খেলেও পস্তাবেন। তাই খেয়ে পস্তানোই ভালো। আর পস্তাতে যখন হবেই, তখন মনে রাখার মতো অনুষ্ঠান করাই ভালো।’

(বিশেষ দ্রষ্টব্য : প্রতিবেদনটি ডয়চে ভেলে থেকে নেওয়া হয়েছে। সেই প্রতিবেদনই তুলে ধরা হয়েছে। হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার কোনও প্রতিনিধি এই প্রতিবেদন লেখেননি।)