পুলিশের একার পক্ষে প্রতিরোধ সম্ভব নয়

রাজনৈতিক উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে নাশকতা ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানীসহ সারা দেশে। গত ২৮ অক্টোবর থেকে যে সহিংসতা শুরু, তা থামার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। গত ১০ দিনে শতাধিক যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। পুলিশ বারবার বলছে, তারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় আছে। কিন্তু বাস্তবে নাশকতা কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জনগণের সম্পৃক্ততা না থাকলে কোনোভাবেই পুলিশের একার পক্ষে এই অগ্নিসন্ত্রাস প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। পুলিশের গোয়েন্দা তথ্যে ঘাটতি ও জনবল সংকটকেও এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তারা।

গত ২৮ অক্টোবর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সমাবেশ, হরতাল ও অবরোধকে কেন্দ্র করে বাস, পিকআপ, প্রাইভেটকার, ট্রাক, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন ধরনের শতাধিক যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। এসব ঘটনায় দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন অনেকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা এসব অগ্নিসন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বলছে, রবি ও সোমবারের অবরোধে ২১টি পরিবহনে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকাতেই ১২টি পরিবহনে আগুন দেওয়া হয়। এছাড়া গত ২৮ অক্টোবর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত ১১০টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ২৮ অক্টোবর ২৯টি, ২৯ অক্টোবর ১৯টি, ৩০ অক্টোবর ১টি, ৩১ অক্টোবর ১১টি, ১ নভেম্বর ১৪টি, ২ নভেম্বর ৭টি, ৪ নভেম্বর ৬টি, ৫ নভেম্বর ১৩টি, ৬ নভেম্বর ১০টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। 

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও গোয়েন্দা প্রধান হারুন অর রশীদ রবিবার (৫ নভেম্বর) রাজধানীর মিন্টো রোডে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এতদিন তো আগুন লাগেনি। অবরোধ ডাকার পরে বাসে আগুন কারা লাগাচ্ছে আমরা জানি। তাদের নাম আমরা পেয়েছি, ছবি পেয়েছি। অবশ্যই তাদের সবাইকে গ্রেফতার করা হবে। আমরা জানি কারা বোমা বানাচ্ছে, কারা ককটেল নিক্ষেপ করছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টদের মতে, চলমান অবরোধ-হরতালকে সমর্থন করে যে জনগণ ঘর থেকে বের হচ্ছে না সেটা নয়। বরং তারা বের হচ্ছে না ভয়ে। গণপরিবহনে অগ্নিসংযোগ, চোরাগোপ্তা হামলার ব্যাপারগুলো মাথায় নিয়ে নিরাপত্তার কথা ভেবে তারা আতঙ্কে আছে।

অন্যদিকে বিএনপিসহ আন্দোলনকারীদের অভিমত, হরতাল-অবরোধের মধ্য দিয়েই তাদের দাবি-দাওয়া পূরণে সরকার একসময় নমনীয় হবে।

তবে এখন পর্যন্ত সরকারের অবস্থান হলো, যথাসময়ে নির্বাচন হবে এবং এ নিয়ে বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ বা রাজনৈতিক সমঝোতার কোনও প্রয়োজন নেই। আন্দোলনের নামে সহিংসতা, নৃশংসতা, জ্বালাও-পোড়াও করলে সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।

অনেক জায়গায় চোরাগোপ্তা হামলা চালানো হচ্ছে উল্লেখ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) ড. খ. মহিদ উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। নির্জন স্থানগুলোকে বেছে নেওয়া হচ্ছে অপরাধের জন্য। এছাড়া যারা আগুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে শনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

রবিবার রাতে নীলক্ষেতে প্রাইভেটকারে আগুন লাগিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিএমপির সাবেক কমিশনার (সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি) মো. আসাদুজ্জামান মিঞা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে যেভাবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিহত করার কাজ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, এভাবেই জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে আগুনসন্ত্রাস প্রতিহত করতে হবে। গাড়ি ভাঙচুর শুধু নয়, যেকোনও ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও জননিরাপত্তা বিধান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার পক্ষে সম্ভব নয়। আইন না মানলে নিরাপত্তা রক্ষা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া ও নিরীহ সুনাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। একইসঙ্গে নাগরিকদের দায়িত্ব আছে আইন মানার সংস্কৃতি চালু ও এর অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার।

তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য প্রতিটি ইঞ্চিতে দাঁড়িয়ে থাকবে তা সম্ভব নয়। আর গোয়েন্দা সংস্থা সব খবরই জানবে তাও সম্ভব নয়। আমরা যে অপরাধগুলো দেখি, হয়তো দেখা যায় যে দুটি অপরাধ হলো বা পাঁচটি অপরাধ হলো। সাধারণ জনগণ হয়তো জানে না এগুলোর বাইরে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কতগুলো অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। এগুলো বেশিরভাগই প্রকাশিত হয় না। মূল কথা হলো, জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা বা জনগণের নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, হরতাল কিংবা অবরোধকে কেন্দ্র করে গণপরিবহনগুলোতে আগুনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ও আতঙ্ক কাটাতে সহজ কোনও উপায় নেই। একটাই উপায় আছে—রাজনৈতিক দলগুলো যদি আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে একটি সমঝোতায় আসে। তাহলেই সব আতঙ্ক কেটে যাবে। আর এটি না আসা পর্যন্ত কোনোভাবেই আতঙ্ক কাটানোর সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দোষারোপ করে লাভ নেই। তাদের একার পক্ষে এই অগ্নিসন্ত্রাস প্রতিরোধ সম্ভব নয়। কেউ হয়তো রাতে বা সন্ধ্যায় গাড়িতে হামলা, ভাঙচুর বা পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করলো; আর আমাদের দেশে তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এত সদস্য নেই যাতে আমরা সারা দেশকে নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারি করতে পারবো। আমাদের সব কিছু নির্ভর করছে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ তৈরির ওপর।

আরও পড়ুন-

কত যান পোড়ানো হলো অবরোধের দুই দিনে

রাজনৈতিক অস্থিরতায় অন্যান্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কতটা তৎপর পুলিশ?

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্কতার পরও এত গাড়িতে অগ্নিসংযোগ কীভাবে?

আবারও অবরোধ: নাশকতা ঠেকাতে কোন পথে পুলিশ

সংঘর্ষ, গুলি, আগুন, ভাঙচুর ও প্রাণহানিতে শেষ হলো ৩ দিনের অবরোধ