জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের উদ্বেগ প্রশ্নবিদ্ধ

বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা ইস্যুতে উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক কমিশন। সোমবার (১৩ নভেম্বর) জেনেভায় মানবাধিকার ইস্যুতে শুনানিকালে বেশ কয়েকটি দেশের এই উদ্বেগ জরুরি উল্লেখ করেও কিছু জায়গায় প্রশ্ন তুলেছেন নারী অধিকারকর্মীরা। তাদের দাবি, মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে কথা বলতে হলে সেখানে সামগ্রিকতা থাকতে হবে, কনটেক্সট বুঝতে হবে। বিশ্বজুড়ে বিশ্বমোড়লদের তৈরি করা নারীর ওপর সহিংসতাকে এড়িয়ে বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলার বিরোধিতা করেন তারা। তবে বাংলাদেশের সহিংসতা পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ চালিয়ে যেতে হবে বলেও মনে করেন তারা। কেননা, কাজ ও আলাপের মাধ্যমেই চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করতে পারায় গত দুই দশকে সরকারি-বেসরকারি তৎপরতায় বেশকিছু জায়গায় সহিংসতা কমানো গেছে বলেও মত তাদের।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসের হিসাব বলছে— বাংলাদেশে যৌন হয়রারি-কেন্দ্রিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন ১৫৪ জন নারী ও পুরুষ। যাদের মধ্যে হামলার শিকার হয়েছেন ৭৯ জন নারী ও ৭৫ জন পুরুষ। এরমধ্যে বখাটেদের হাতে যৌন হয়রানির হয়েছেন ৬১ জন, বখাটেদের উৎপাতকে কেন্দ্র করে সংঘাতে আহত হয়েছেন ৭২ জন। এদের মধ্যে যৌন হয়রানির কারণে ১০ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। অপরদিকে, যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে বখাটেদের হাতে তিন জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে একজন নারী ও দুই জন পুরুষ। রএ সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৯৪ নারী।

ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২০ জন নারীকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে তিন জন নারী। এছাড়া ৬৬ জন নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ২৫৩ জন নারী। এরমধ্যে ১৫৬ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে। পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৫৯ জন নারী। এছাড়া শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৮ জন নারী। যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৭৪ জন নারী। যৌতুকের জন্য শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ৩৪ জনকে এবং যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৩ জন নারী। এরমধ্যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৭ জন। এ সময়কালে ১৩ জন গৃহকর্মী বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নারীর প্রতি সহিংসতা ইস্যুটিকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই। প্রতি বছর নারীর প্রতি সহিংসতার অবসান চেয়ে ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ করেন হাজারো মানুষ। জাতিসংঘের লৈঙ্গিক সমতাবিষয়ক সংস্থা ইউএন উইমেনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি তিন জন নারীর মধ্যে একজন শারীরিক কিংবা যৌন সহিংসতার শিকার হন।

তারা ২০২১ সালের সবচেয়ে বড় প্রতিরোধের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে সে বছর মেক্সিকো সিটি, মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, প্যারিস ও লন্ডনের রাস্তায় হাজারো মানুষ বিক্ষোভে শামিল হন। চিলি, ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া, উরুগুয়ে, কোস্টারিকা, পানামা, কলম্বিয়াতেও বিক্ষোভ হয়। কেননা, মেক্সিকোতে প্রতি দিন প্রায় ১০ জন নারী হত্যার শিকার হন। তুরস্কেও নারী নির্যাতনের হার দিন দিন বাড়ছে। এরমধ্যে হত্যার প্রবণতা বেশি। এমনকি জাতিসংঘের আঞ্চলিক কমিশনের মতে, অনলাইনে সহিংসতার হার নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের আরও সতর্ক হওয়া দরকার।

একশনএইডের ‘বাংলাদেশে অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, অনলাইনে প্রায় ৬৪ শতাংশ নারী সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। নারীরা সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও অনলাইনে বার্তা আদান-প্রদানের মাধ্যম মেসেঞ্জারে।

আন্তর্জাতিক এসব সংস্থা থেকে পরামর্শ আসা খারাপ কিছু না উল্লেখ করে ‘উই ক্যান’ এর নির্বাহী সমন্বয়ক জিনাত আরা হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সহিংসতার ধরন এখন বদলেছে। সারা বিশ্বেই সহিংসতার একটা চিত্র আছে। যুদ্ধ শুরু হলে, দুর্যোগ পরিস্থিতিতে নতুন নতুন আধিপত্যবাদ তৈরি হয় এবং তাতে ভঙ্গুর পরিস্থিতিতে পড়ে সবার আগে নারী। সেদিক থেকে সামগ্রিকভাবে চ্যালেঞ্জ বেড়ে গেছে। মানবাধিকার কমিশনে এসব উঠে আসতে হবে। বাংলাদেশে সমস্যা যেমন আছে, তেমনই সমস্যার উৎপত্তি নিয়ে আলাপ করতে হবে। এর সঙ্গে জঙ্গিবাদের বৈশ্বিক উত্থানের বিষয়টিকে সামনে আনতে হবে। পশ্চিমারা ফিলিস্তিনের ঝামেলা জিইয়ে রাখবে, আবার ইরাকে মধ্যপ্রাচ্যে মন মতো শাসন ব্যবস্থা করতে চাইবে— এসব কৌশলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ। একদিকে টেকসই উন্নয়নের কথা বলে পিছিয়ে পড়াদের এগিয়ে নেওয়ার কথা বলবেন, আরেকদিকে মানুষকে পেছনের দিকে ঠেলে দেবেন। সেটাতো কৌশল হিসেবে খারাপ। যখন আপনি সার্বিক উন্নয়ন চাইবেন, তখন আপনার সবদিকে চোখ খোলা রাখতে হবে। মানবাধিকার রিপোর্ট নিয়ে কথা বলতে গেলে সবকিছু নিয়ে আলাপ তুলতে হবে। কনটেক্সট বিবেচনা করতে হবে।’

নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সরকারের নানাবিধ প্রচেষ্টার পাশাপাশি দীর্ঘদিনের বেসরকারি উদ্যোগও কার্যকর আছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘মানবাধিককার ইস্যু শুধু নয়, আরও অনেক বিষয়েই বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক পরিসরে নজরদারিতে আছে বলেই হয়তো এটা বেশি আলাপে এসেছে। নারীর প্রতি সহিংসতা কোনও এক দেশের ইস্যু না। এটা সামগ্রিকভাবে ঘটে। পার্শবর্তী দেশ ভারতে নির্যাতনের গভীরতা, আফগানিস্তানে নারীর প্রতি যে সহিংসতা ঘটে, সেসব বিষয়কে বিচ্ছিন্ন জায়গা থেকে দেখার সুযোগ নেই। তারা পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনটি দিলে আমরা প্রাতিষ্ঠানিক জায়গা থেকে বিবেচনায় নেবো।’