সন্দীপ সরকার, কলকাতা: বাইশ গজের ওপর নির্দিষ্ট একটা জায়গায় লাল রং দিয়ে বৃত্ত এঁকে দেওয়া হয়েছে। কঠোর গলায় কোচের নির্দেশ, অন্তত দশটি বল ওই বৃত্তে ফেলতে হবে। আর তার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হচ্ছে ৩০ মিনিট। গুরুর নিদান মেনে ছাত্ররা বোলিং শুরু করল ওই লাল বৃত্তাকার জায়গায় দশবার বল ফেলার লক্ষ্য নিয়ে। তবে নজর কেড়ে নিল বছর পনেরোর এক বোলার। অদ্ভুত অ্যাকশন। যেন বল করছেন না, মনের আনন্দে গাছের আম পাড়ার জন্য নিশানা করছেন। কিন্তু অভ্রান্ত। দশটি বল নিখুঁতভাবে বৃত্তে ফেলতে খুব বেশি সময় লাগত না। বড় জোর মিনিট দশেক। দেখে বাহবা দিতেন মুগ্ধ কোচ। তাজ্জব হয়ে যেত সতীর্থরা।
শুনতে শুনতে মনে হবে, এই কাহিনির সঙ্গে মুম্বইয়ের শিবাজি পার্কের এক ঐতিহাসিক ঘটনার কী মিল! যেখানে স্টাম্পসের ওপর বসিয়ে দেওয়া হতো কয়েন। আর কড়া গলায় গুরু রমাকান্ত আচরেকর নির্দেশ দিতেন, এমনভাবে ব্যাট করো, যাতে একবারও আউট না হতে হয়। তাহলেই কয়েনটা তোমার। সারাদিন ধরে অপরাজিত থেকে যেতেন যিনি, তাঁকে বলা হতো বিস্ময় বালক। পরে ক্রিকেটবিশ্ব যাঁকে চিনেছে সচিন তেন্ডুলকর (Sachin Tendulkar) নামে। আচরেকর স্যরের নির্দেশ মেনে যিনি নট আউট থাকতেন। এবং পুরস্কার হিসাবে পেতেন সেই মহার্ঘ কয়েন।
তবে লাল বৃত্ত চিহ্নিত করে বোলিং অনুশীলনের ঘটনাস্থল মুম্বই নয়, আমদাবাদের নির্মাণ হাইস্কুলের ক্রিকেট প্র্যাক্টিসের নেট। যেখানে খুদে ক্রিকেটারদের প্রশিক্ষণ দেন কিশোর ত্রিবেদী (Kishore Trivedi)। যাঁর পুত্র সিদ্ধার্থ ত্রিবেদী এক সময় রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে খেলেছেন। তবে কিশোরকে প্রচারের আলোয় নিয়ে এসেছে তাঁর সেই ছাত্র, যিনি এখন বিশ্বের তাবড় ব্যাটারদের ত্রাস। যশপ্রীত বুমরা (Jasprit Bumrah)। গুরু কিশোর ত্রিবেদীর কাছে যিনি ক্রিকেটের পাঠ নিয়েছিলেন।
চলতি বিশ্বকাপে (ODI World Cup) ১০ ম্যাচে ১৮ উইকেট। সর্বোচ্চ উইকেটশিকারিদের তালিকায় পঞ্চম স্থানে বুমরা। সবচেয়ে নজর কাড়ছে তাঁর ইকনমি রেট। ওভার প্রতি মাত্র ৩.৯৮ রান খরচ করছেন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিংয়ের যুগে যা কোনও বোলারের এলিয়েন-সম পরিসংখ্যান। তাঁর ভয়ঙ্কর ইয়র্কারের কোনও জবাব থাকছে না ব্যাটারদের কাছে। প্রথম দশ ওভারের মধ্যে নিয়ম করে উইকেট তুলছেন। এবং কৃপণ বোলিং করে বিপক্ষ ব্যাটিংয়ের এমন নাভিশ্বাস তুলে দিচ্ছেন যে, ত্রাহি ত্রাহি রব পড়ে যাচ্ছে বাইশ গজে। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেও অধিনায়ক রোহিত শর্মার তুরুপের তাস মনে করা হচ্ছে ডানহাতি ফাস্টবোলারকেই।
ছোট থেকেই কি এত নিখুঁত ইয়র্কার করেন বুমরা? আমদাবাদ থেকে মোবাইল ফোনে কিশোর বলছিলেন, ‘নির্মাণ হাইস্কুলের নেটে যখন ওকে প্রথম দেখি, বুমরার বয়স ছিল ১৫ বছর। ছোট থেকেই অদ্ভুত অ্যাকশন। প্রথমে সবাই বলত, ছেলেটা বল ছোড়ে। কিন্তু আমি লক্ষ্য করে দেখি, ওর অ্যাকশনই ওরকম। তবে বৈধ। কোনওভাবেই ছোড়ে না।’ যোগ করলেন, ‘আমি সব ছেলেদের নিয়ম করে প্র্যাক্টিসে আধ ঘণ্টা ইয়র্কার করাতাম। পিচে লাল গোল দাগ টেনে সেখানে অন্তত দশটি বল ফেলতে বলতাম। বুমরার দশ মিনিটও লাগত না।’
কোনওদিন ছাত্রের অ্যাকশন পাল্টানোর কথা ভেবেছেন? ‘না। কারণ, ওর অ্যাকশনই সবচেয়ে বড় অস্ত্র। একই অ্যাকশনে ইনস্যুইং ও আউটস্যুইং করায়। ব্যাটসম্যান তো ধরতেই পারে না বল ভেতরে ঢুকবে না বাইরে বেরবে,’ বলছিলেন গর্বিত গুরু। কিন্তু চোট আঘাত? কিশোরের কথায়, ‘ওর চোট লেগেছিল অ্যাকশনের জন্য নয়। অতিরিক্ত ক্রিকেট খেলার ধকলের কারণে। এখন তো সম্পূর্ণ ফিট।’
কিশোর শোনালেন এক মজার গল্পও। বললেন, ‘ও এত গতিতে বল করে ছোট থেকেই যে, নেটেও কেউ ওর বিরুদ্ধে ব্যাট করতে চাইত না। ওকে খেলতে ভয় পেত। বয়সে অনেক বড় ব্যাটারদের কাছেও আতঙ্ক ছিল।’
নির্মাণ হাইস্কুলের অধ্যক্ষা ছিলেন বুমরার মা। তিনিই ছেলেকে তুলে দেন কিশোরের হাতে। ক্রিকেটার গড়ে তোলার বাসনা নিয়ে। স্কুল ক্রিকেটে নজর কাড়ার পর আইপিএলে সাফল্য। রাজ্য ও জাতীয় দলে সুযোগ। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি বুমরাকে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিন ধরনের ফর্ম্যাটে ৩৪৯ উইকেট। ভারতের সর্বকালের সেরা পেসারদের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে ২৯ বছরের তারকা।
বিশ্বকাপে কেমন দেখছেন বুমরাকে? কিশোর বলছেন, ‘ওর অভিজ্ঞতা বেড়েছে। যত ম্যাচ খেলছে, আরও নিখুঁত হয়ে উঠছে। ইয়র্কার, দু’দিকে স্যুইং, রিভার্স স্যুইং – বুমরা সত্যিই বিপজ্জনক ফাস্টবোলার। ফাইনালেও অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটারদের অগ্নিপরীক্ষা নেবে।’
আরও পড়ুন: ODI World Cup Exclusive: দু’পা দৌড়ে অভিনব প্রস্তুতি, কীভাবে ব্যাটারদের আতঙ্ক হয়ে উঠলেন শামি?
আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম টেলিগ্রামেও। যুক্ত হোন
https://t.me/abpanandaofficial
আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।