কারাগারে পরিচয়, বের হয়ে দলবেঁধে স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি

নোয়াখালীর কবিরহাটে নৈশপ্রহরীকে হত্যা করে স্বর্ণের দোকানে ডাকাতির ঘটনায় মামলার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে লুট হওয়া স্বর্ণ, রৌপ্য, নগদ টাকা এবং আগ্নেয়াস্ত্রসহ পাঁচ ডাকাত ও তাদের দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, কারাগারে থাকাকালে পরিচয় ও বন্ধুত্বের সুবাদে বড় ধরনের ডাকাতির পরিকল্পনা করেন তারা। সোমবার (১১ ডিসেম্বর) দুপুর ১২টার দিকে নিজ কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান নোয়াখালীর পুলিশ সুপার মো. শহীদুল ইসলাম। 

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত ৮ ডিসেম্বর (শুক্রবার) ভোরে কবিরহাট উপজেলার চাপরাশিরহাট ইউনিয়নের চাপরাশিরহাট বাজারে নৈশপ্রহরীকে হত্যার পর দুটি স্বর্ণের দোকানে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে কবিরহাট থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়।

প্রাথমিকভাবে জানা যায়, আনুমানিক ১০/১৫ জনের একটি ডাকাত দল রাত ৩টার পর চাপরাশিরহাট বাজারে প্রবেশ করে নৈশপ্রহরীসহ অন্যান্য চলাচলকারী লোকজনুদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে হাত-পা বেঁধে আনুমানিক দেড়/দুই ঘণ্টাব্যাপী ডাকাতি করে। এ সময় ডাকাত দলকে বাধা দিতে গেলে তারা নৈশপ্রহরী শহিদুল্লাহকে মাথায় আঘাত করে। এতে ঘটনাস্থলেই নৈশপ্রহরী শহিদুল্লাহ মারা যান। এ হত্যাসহ ডাকাতির ঘটনায় কবিরহাট থানায় পেনাল কোড ৩৯৬ ধারায় একটি মামলা রুজু করা হয়।

পুলিশ সূত্রে আরও জানা যায়, মামলা রুজুর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ও ডাকাতির মালামালসহ  ৭ ডাকাতকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার তোরাবগঞ্জ ইউনিয়নের চরপাগলা গ্রামের মৃত শহীদুল্লার ছেলে মো. নোমান (৩৫),  একই উপজেলার চর মার্টিন ইউনিয়নের পশ্চিম চর মার্টিন গ্রামের মোরশেদ আলমের বাড়ির মো. মোরশেদ আলমের ছেলে মো. সুজন হোসেন (২৭), হাজীরহাট ইউনিয়নের কৃঞ্চপুর গ্রামের ছৈয়াল বাড়ির সুভাষ চন্দ্র সরকারের ছেলে কৃঞ্চ কমল সরকার (৩২), নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার নদনা ইউনিয়নের জগজীবনপুর গ্রামের মৃত আব্দুর রহিমের ছেলে মো. শাহাদাত হোসেন (৩২), একই উপজেলার বজরা ইউনিয়নের মুসলিম গ্রামের হাজী বাড়ির মো. সোলেমানের ছেলে মো. সাদ্দাম হোসেন ওরফে জিতু (৩০), বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী পৌরসভার করিমপুর এলাকার মুন্সি বাড়ির মৃত অলি উল্যার ছেলে সালাউদ্দিন (৩২) ও কবিরহাট উপজেলার কবিরহাট পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের জৈনদপুর গ্রামের মোশারফ বিএসসির বাড়ির মৃত মো. শহীদুল্লার ছেলে মো. মিজানুর রহমান ওরফে রনি (৩৬)।  

জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক তারা সালাউদ্দিনের গ্যারেজে একত্রিত হয়। শাহাদাত চট্টগ্রাম থেকে ট্রাক আনে। সেই ট্রাকে করে শাহাদাত, সালাউদ্দিনসহ প্রায় ৫/৬ জন লোককে ডাকাতির উদ্দেশ্যে  বেগমগঞ্জের চৌমুহনীর চৌরাস্তায় নিয়ে আসে। অন্য দিকে রনি তার সাথে আরও ৪ জনকে নিয়ে কবিরহাট থেকে চৌরাস্তায় আসে। রনি চৌরাস্তায় এসে শাহাদাতের সাথে মিলিত হয়। পরবর্তীতে সবাই একসাথে বেগমগঞ্জ চৌরাস্তা থেকে রাত ১টায় রওনা দেয়। ট্রাকটি ডাকাতদের নিয়ে চৌমুহনী-সেনবাগ হয়ে দাগনভূঁইয়া বাজারের কিছু আগে সময়ক্ষেপণ করার জন্য আধাঘণ্টা অপেক্ষা করে। পরে আবার রাত আড়াইটায় সেখান থেকে চাপরাশিরহাটের উদ্দেশ্যে রওনা করে। রাত আনুমানিক সাড়ে ৩টায় তারা দুধমুখা বাজার হয়ে ভূঁইয়ার হাট বাজারে পৌঁছে বামে ইউটার্ন নিয়ে কোম্পানীগঞ্জ বাজারে না ঢুকে নির্জন শাখা রোডে ঢুকে চাপরাশিরহাট বাজারে পৌঁছে। 

প্রথমে তারা বাজারের পশ্চিম পাশে নামে। নেমে বাজারের নৈশপ্রহরীকে দেশীয় অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে মুখে স্কচটেপসহ হাত-পা বেঁধে ট্রাকে তোলে। তারপর আবার ট্রাক নিয়ে সামনে যায় এবং অন্য একজন নৈশপ্রহরীকে একইভাবে মুখে স্কচটেপসহ হাত-পা বেঁধে ফেলে। দুইজনকে বাধার পর বাজারের পূর্বাংশে গেলে সেখানে অন্য দুইজন নৈশপ্রহরীর সাথে দেখা হলে তাদেরকেও একই কায়দায় বেঁধে ট্রাকে তোলে। কিন্তু একজন নৈশপ্রহরী ডাকাতদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তাকে ডাকাতদের মধ্য থেকে কেউ আঘাত করে। ধারণা করা হচ্ছে, ডাকাতদের কারো আঘাতের ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে নৈশপ্রহরী মারা যান। 

সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার বলেন, খবর পেয়ে পুলিশের একাধিক টিম ঘটনার তদন্ত শুরু করে। মামলার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দুই সহযোগীসহ ৫ ডাকাতকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হই। এ সময় তাদের কাছ থেকে লুণ্ঠিত ৬০ ভরি স্বর্ণ-১৬০ ভরি রুপা এবং স্বর্ণ বিক্রির ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, একটি দেশীয় তৈরি পাইপগান ও দুই রাউন্ড কার্তুজ, একটি গ্যাস সিলিন্ডার ও একটি পাইপ উদ্ধার করা হয়েছে।  

পুলিশ সুপার মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, এই দুর্ধর্ষ ডাকাতির পরিকল্পনাকারী মো. শাহাদাত। ২০১৮ সালে তার সাথে মো. মিজানুর রহমান রনির পরিচয় হয়। ওই সময় দুজনই জেলে ছিলেন। জেল থেকে বের হয়ে তারা দুজনে মিলে নোয়াখালী ও আশপাশের জেলায় বিভিন্ন সময় ডাকাতির চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা সফল হতে পারেননি। গত ৮ ডিসেম্বর এই ডাকাতির ১৫ বা ২০ দিন আগে শাহাদাত ও রনি চাপরাশিরহাট বাজার রেকি করেন। এ সময় তারা মা-মনি জুয়েলার্সকে টার্গেট করেন। রেকির পর তারা বিভিন্ন সময়ে বেগমগঞ্জে অবস্থিত সালাউদ্দিনের দোকানে বসে পরিকল্পনা করেন। কে কতজন লোক আনবে, কে কি অস্ত্র নিবে, কীভাবে, কখন ডাকাতি করতে যাবে এসকল পরিকল্পনা শেষে তারা সালাউদ্দিনের দোকানে বসে দিন তারিখ ঠিক করেন ডাকাতি করার জন্য। 

তিনি আরও বলেন, সকল নৈশপ্রহরীকে বেঁধে ফেলার পর তারা পরিকল্পনা মাফিক মা-মনি জুয়েলার্সে ডাকাতি শুরু করে। দোকানের মেইনগেট কাটার দিয়ে ভাঙার চেষ্টা করেন, কিন্তু সেটা ভাঙা সম্ভব হয় না। পরবর্তীতে তারা বিকল্প হিসেবে গ্যাস কাটার ব্যবহার করে সফল হয়। তারপর দোকানের তালা ভেঙে দোকানে ঢুকে এবং সিন্ধুক কাটার জন্য প্রথমে নকল চাবি ব্যবহার করেন। কিন্তু তাতে কাজ না হওয়ায় গ্যাস কাটার ব্যবহার করে সিন্দুক কেটে স্বর্ণালংকার ডাকাতি করেন। পরবর্তীতে নুর জুয়েলার্সে যায় ডাকাতি করতে। সেখানে স্বর্ণের নাকের দুল ও রূপা ডাকাতি করেন। ডাকাতি করার সময় তারা মা-মনি জুয়েলার্সের সিসিটিভি ভেঙে হার্ডডিস্ক খুলে নিয়ে যান। ডাকাতির সময় তারা পরস্পর পরস্পরকে ‘মেম্বার’ বলে সম্বোধন করে। 



আশরাফুল/সা.এ.