মুখভার উৎসবে খই ফোটালো শর্মিলা-অঞ্জনের আলাপ

পৃথিবীতে এমন ঘটনা খুব কমই ঘটে, যেটা এবার ঘটলো ২২তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। ২০ তারিখে পর্দা উঠেছে বটে, কিন্তু আলো অথবা আলাপের স্বল্পতা ছিলো একেবারে উদ্বোধনী আসর থেকে প্রায় প্রতিটি পর্বে। অবশেষে ৬ দিনের মাথায় সব সমালোচনা ছাপিয়ে ২৬ জানুয়ারি যেন ঝলমলে আর কলধ্বনিময় দিন পার করলো এবারের উৎসব। 

অথচ দুনিয়ার তামাম উৎসবে ৬ষ্ঠ দিনে এসে শুরু হয় সূর্যাস্তের বিষণ্ণতা। কিন্তু ঢাকা উৎসবে সেটি হতে গিয়েও হলো না উত্তম নায়িকা শর্মিলা ঠাকুর আর রঞ্জনার প্রেমিক অঞ্জন দত্তের সুবাদে। দু’জনেই যেন উৎসবের দুটি ভেন্যুতে আজ কথার আগল খুলে বসলেন গণমাধ্যমকর্মীদের ডেকে। অথচ গত ছয়টি দিন শর্মিলার মুখ থেকে আনুষ্ঠানিকতার বাইরে টু শব্দটিও বের করা যায়নি। সে ক্ষেত্রে দত্তবাবু অনেকটাই নির্দোষ, কারণ উৎসবে তার আনুষ্ঠানিক পদধূলি পড়েছে আজই (২৬ জানুয়ারি)।

শর্মিলা ঠাকুর এরমধ্যে শর্মিলা ঠাকুর উৎসবে এসেছেন অন্যতম অতিথি কিংবা জুরি হিসেবে। অন্যদিকে অঞ্জন এসেছেন পরিচালক-অভিনেতা হিসেবে মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে লড়াই করতে। তার সিনেমা ‘চালচিত্র এখন’। যেখানে উঠে এসেছে কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের নানান দিক।

শর্মিলা ঠাকুর এবার শোনা যাক উৎসবের প্রথম থেকে চুপ থাকা কিংবদন্তি শর্মিলা ঠাকুরের মুখে খইফোটা গল্পগুলো। শুক্রবার (২৬ জানুয়ারি) বিকাল ৪টায় রাজধানীর ঢাকা ক্লাবে আয়োজিত প্রেস মিটে বসে তিনি যেন উজাড় করে দিলেন জমানো সব কথা। যে কথায় অভিনেত্রী তুলে ধরেছেন তার একান্ত ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে গভীর সুন্দরবনে উত্তম কুমারের সঙ্গে শুটিং স্মৃতি হয়ে দু’দিন আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে খোশগল্পের আলাপ। বাদ রাখেননি ঢাকার জ্যাম যন্ত্রণা আর শপিং করতে না পারার গল্পটাও।

শর্মিলা ঠাকুর অভিনেত্রী জানান, যখন তিনি ক্যারিয়ারে চূড়ান্ত জনপ্রিয়তায়, তখনই বিয়ে করেন নবাব মনসুর আলী খানকে। অনেকেই তখন শর্মিলাকে যুক্তি দিয়েছিলেন, ক্যারিয়ারে এই সু-সময়ে বিয়ে করা ঠিক হচ্ছে না! কিন্তু তিনি কারও কথা শোনেননি।

সংস্কৃতিজন আসাদুজ্জামন নূর এমপি ও শর্মিলা ঠাকুর শর্মিলার ভাষায়, ‘নিজের ইচ্ছায় বিয়ের পিঁড়িতে বসেছি। কারণ আমি মনে করেছি ঠিক সময়ে বিয়ে করা, বাচ্চা নেওয়া জরুরি। আমার যখন মনে হলো বিয়ে করা উচিত তখন করেছি। যখন মনে হয়েছে নারী হিসেবে আমার মা হওয়া উচিত, হয়েছি। যেটা মনে হয়েছে, সেটাই আমি করেছি। অনেকে ভেবেছিলো নবাবকে বিয়ে করেছি যেহেতু, দুই বছরের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যাবে! আবার অনেকেই আমার হাজবেন্ডকে বলেছে- কিভাবে একজন নায়িকাকে বিয়ে করছো! তোমাকে তো ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু আমরা কারও কথা শুনিনি। নিজেদের সিদ্ধান্তে নিজেরা হ্যাপি থেকেছি।’  

শর্মিলা ঠাকুর সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে আজকের এই শর্মিলা ঠাকুর। কথা প্রসঙ্গে টানলেন সেই স্মৃতিটুকুও। বললেন, ‘আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে, আমার প্রথম ছবি (অপুর সংসার) মানিক দার (সত্যজিৎ রায়) সঙ্গে। তখন স্কুলে পড়তাম, আমার বয়স ১৩ বছর। একদিন ফোন এলো সত্যজিৎ রায় আমাকে ‘অপুর সংসার’-এ নিতে চান। যখন আমি অপর্ণা চরিত্র করলাম খুবই পপুলার হয়ে গেলাম। তাই আমাকে সেভাবে স্ট্রাগল করতে হয়নি। আমার পরিবার চায়নি যে, আমি কখনও ফিল্মে কাজ করি। যদি সত্যজিৎ রায়ের ছবির অফার না আসতো আমার জীবনটা অন্যরকম হতো।’

শর্মিলা ঠাকুর কার সঙ্গে বেশি বন্ধুত্ব? উত্তম নাকি সৌমিত্র। এড়িয়ে যাননি। ভণিতাও করেননি। বরং বলার ভঙ্গিতে এটুকু স্পষ্ট, যা বলেছেন হৃদয় থেকেই। জানালেন, উত্তম নয়, সৌমিত্রই ছিলো তার আসল বন্ধু। তার ভাষায়, ‘‘সৌমিত্র আর আমি শুরু করি মানিক দার মাধ্যমে একসঙ্গে একই সিনেমা (অপুর সংসার) দিয়ে। তারপর আমাদের গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। উনাকে আমি খুবই মিস করি। আলাদা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো আমার। আর উত্তম বাবুর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ফর্মাল ছিলো। ‘নায়ক’, ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’, ‘শেষ অংক’, ‘অমানুষ’ এমন অনেক ছবি করেছি। ওনাকে অনেক রেসপেক্ট করতাম। ‘অমানুষ’ যখন করেছি, তখন একমাস আমরা সুন্দরবনে ছিলাম একটা অস্থায়ী কাঠের ঘরে। অসম্ভব গরম ছিলো। রাতে দেখতাম কাঠের উপর ইঁদুর হাঁটছে। সাবান যেটা রাখতাম, সকালে দেখতাম নেই। ইঁদুর খেয়ে ফেলেছে। এমন একটি কঠিন আউটডোরে দেখেছি, উত্তম বাবু কেমন করে আমাদের সবাইকে চিয়ারআপ করতেন। গাইতেন, আড্ডা দিতেন। এই স্মৃতিগুলো খুব মনে আছে। এটা তো সত্যি, জনপ্রিয়তার বিচারে ওনার কাছে এখনও কেউ যেতে পারেনি।’’

শর্মিলা ঠাকুর এবার ঢাকায় এসে প্রচুর ট্রাফিক জ্যামে পড়েছেন শর্মিলা ঠাকুর। যেটার ভয়ে তিনি এবার শপিং বা ঘুরতেও বের হননি নির্দিষ্ট কাজের বাইরে। নিজের হোটেল রুমে বসেই গত ছয়দিনে দেখেছেন উৎসবের ১৫টি ছবি! এরমধ্যে উৎসবের বাইরে দেখা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। কী কথা হলো তাঁর সঙ্গে, সেটিও বলে দিলেন অকপটে।

শর্মিলার ভাষায়, ‘প্রধানমন্ত্রী এখন প্রচুর ব্যস্ত। নতুন মন্ত্রীসভা। প্ল্যানিং কমিশনের মিটিং ছিলো। এরমধ্যেও তিনি আমাদের সময় দিলেন। কথা বললেন। প্রচুর খেলাম। ছবি তুললাম। পরদিন ছবিটি পেয়েও গেলাম হাতে। দারুণ অভিজ্ঞতা।’

শর্মিলা ঠাকুর কিন্তু কী কথা হলো তাঁহার সনে! সেটাও গোপন রাখলেন না শর্মিলা। বললেন, ‘সিনেমা নিয়ে কথা বলেছি আমরা। একবার প্রণব বাবুর সঙ্গে ঢাকায় এসেছিলাম আবৃত্তি করতে। সেটা তিনি মনে করিয়ে দিলেন। এরমধ্যে আমাদের উৎসব প্রধান একটা আবদার করলেন, সিনেমা দেখানোর জন্য ৫টা থিয়েটার চাইলেন। আমি তখনই মজা করে বললাম, ৩টা দিয়ে শুরু করুন! এরপর দেখলাম উনি (প্রধানমন্ত্রী) বেশ আন্তরিকভাবেই নিলেন কথাটি। বললেন, থিয়েটার বানানো আলাদা কথা কিন্তু আমি জায়গাটা দিতে পারি। একজন প্রধানমন্ত্রী যখন এভাবে আলাপ করেন, তখন এটুকু অনুমান করা যায় তিনি সিনেমা বা সংস্কৃতি প্রাণ একজন মানুষ। উৎসবের বিষয়ে খুবই সাপোর্টিভ মানুষ। ওনাকে দেখে খুবই সাধারণ মনে হলো। মনেই হয়নি এখন বিরাট পারসোনালিটির সামনে এসে বসেছি। খুব আপনজনের মতো লাগলো।’

অঞ্জন দত্ত এদিকে একই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ উৎসবের মূল কেন্দ্র জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ান অঞ্জন দত্ত। মূল উদ্দেশ্য তার ছবি ‘চালচিত্র এখন’ সম্পর্কে হলেও, প্রশ্নের দাবিতে অঞ্জনও যেন মুখের আগল খুলে দিয়েছেন। জানিয়ে দিয়েছেন, মৃণাল সেন না থাকলে তার আসলে কিছুই হয়ে ওঠা হতো না। হারিয়ে যেতেন।

বিধান রিবেরু ও অঞ্জন দত্ত তার ভাষায়, ‘আমার আসলে এই দেশেই (কলকাতা/ভারত) থাকার ইচ্ছা ছিলো না। জার্মানি থিতু হতাম। সিনেমা তো পছন্দই করতাম না। বাংলা সিনেমা তো নয়-ই। থিয়েটার করতে ভালো লাগতো। এরপর মৃণাল সেনের সঙ্গে দেখা হলো। আমার জীবন বদলাতে থাকে। ওনার সিনেমার গল্প লেখা শুরু করি। ওনার সিরিয়ালের লাইন প্রডিউসার হই। ওনার বাসায় যাওয়া শুরু করি। একটা ২৪ বছরের ছেলের সঙ্গে আরেকজন ৫৭ বছরের মানুষের একটা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এরপর সিনেমা করেছি, গান করেছি। আমার অনেক কাজেই নিজের অনেক কিছু এনেছি। আমার স্কুল, দার্জিলিং, রাজনীতি, শৈশব, স্কুল, পরিবার। অনেক এনেছি। কিন্তু মৃণাল সেন আমার কোনও কাজে রিফ্লেক্ট হয়নি। কারণ তিনি এতোটা কাছের, তাকে দূর থেকে দেখা হয়নি। একটা তথ্যচিত্র করতে চেয়েছি। সেটাও হয়নি। ফলে এটা একটা অস্থিরতা ছিলো আমার ভেতর। সেই তাড়না থেকেই এই গল্পটা বানাই। এরপর আমি আর আমার পুত্র নীল মিলে নিজেদের টাকায় ছবিটা বানাবো। তাই করেছি।’

অঞ্জন দত্ত এভাবে প্রায় এক ঘণ্টা নানাবিধ প্রশ্নের জবাব দিলেন নির্মাতা অঞ্জন। কৃতজ্ঞতার স্বরে বারবারই বলার চেষ্টা করেছেন, কলকাতা আর ঢাকা- এই দুটো শহরই আসলে তাকে অনেক দিয়েছে। সেই শহরে তার ছবিটি দেখাতে পেরে তিনি আনন্দিত। সঙ্গে এটুকুও বলেন, ‘তিনি (মৃণাল সেন) যদি জানতে পারতেন, ছবিটি ঢাকায় দেখানো হচ্ছে, তবে বড় খুশি হতেন।’ অঞ্জন দত্ত

২০ জানুয়ারি থেকে চলা এই উৎসব শেষ হচ্ছে ২৮ জানুয়ারি। অঞ্জন দত্ত

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন