Rezwana Chowdhury Bannya: ‘বাঙালি জাতিসত্তার জন্য রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার সম্মান গুরুত্বপূর্ণ, রাজনৈতিক দলটি বড় কথা নয়’

সাধারণতন্ত্র দিবসের আগের সন্ধ্যায় ঘোষিত হয়েছে পদ্মসম্মান প্রাপকদের নামের তালিকায়। সেই তালিকায় নাম রয়েছে বাঙালি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। পদ্মশ্রী পেলেন প্রখ্যাত গায়িকা। তাঁর এই সম্মান কি বিশেষ কোনও বার্তা? প্রভাব পড়বে আগামী দিনের রবীন্দ্রচর্চায়? পিছনে কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে? হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার প্রশ্নের উত্তর দিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ও রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ রাজশ্রী ভট্টাচার্য। 

 

  • প্রশ্ন: সমসাময়িক শিল্পী হিসাবে আপনি রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে দীর্ঘ দিন ধরে চেনেন। তিনি এই সম্মান পেলেন, এটা জানার পরে কেমন অনুভূতি হচ্ছে?

রাজশ্রী: সমসাময়িক বলা যায়, যদিও বন্যাদি (রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা) বয়সে আমার কিছু চেয়ে কিছুটা বড়। তাঁর এই সম্মান পাওয়ার খবর শুনে খুবই আনন্দিত হয়েছি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁকে আমার শ্রদ্ধা, সম্মান, প্রণাম এবং অভিনন্দন। অত্যন্ত যোগ্য একজন মানুষকে এই সম্মান প্রদান করা হল। তিনি বাংলাদেশের মানুষ, নাকি ভারতীয়— এক্ষেত্রে সেটিও বড় কথা নয়। তিনি বাঙালি হিসাবে এই সম্মান পেলেন, সেটিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের জন্য গর্বের। তাছাড়া মানুষ হিসাবেও উনি অতুলনীয়।

 

  • প্রশ্ন: বাঙালিদের জন্য এই দিনটি তাহলে নিশ্চয়ই খুব সম্মানের?

রাজশ্রী: অবশ্যই। বন্যাদি বাঙালি জাতিসত্তাকে আলাদা করে খুব গুরুত্ব দেন। বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখের অন্যতম আকর্ষণ হল রমনার বটমূলে ছায়ানটের তরফে সংগঠিত অনুষ্ঠানটি। তার পাশাপাশি আরও একটু অনুষ্ঠান করে ‘সুরের ধারা’ সংগঠন। সেটিও কোনও অংশে কম নয়। আর এই ‘সুরের ধারা’ বন্যাদিরই সৃষ্টি। এই সংগঠন আজ বাঙালির সঙ্গীতচর্চায় বড় ভূমিকা নিচ্ছে। আর তার পিছনে কাজ করছে বাঙালির জাতিসত্তার বোধ। সেখানে বন্যাদির ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না।

 

  • প্রশ্ন: ওঁর গানের মূল্যায়ন করতে বসলে, আপনি কী বলবেন?

রাজশ্রী: কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ওঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমার প্রিয় শিষ্য’। এর পরে ওঁর প্রতিভা, ওঁর ক্ষমতা নিয়ে কারও আলাদা করে কিছু বলার থাকতেই পারে না। বন্যাদি কম বয়স থেকেই কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে থাকতেন, ওঁর কাছে শিক্ষা পেয়েছেন। বন্যাদি শান্তিনিকেতনে থেকে অনেক বছর পড়াশোনা করেছেন। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহচর্য তখন থেকেই পান। তার পাশাপাশি শান্তিদেব ঘোষ, নীলিমা সেনের মতো আরও বহু দিকপাল সঙ্গীতগুরুর ছাত্রী তিনি। শিল্পী হিসাবে আলাদা করে তাই এখন ওঁর গানের গুণমান বিশ্লেষণের প্রয়োজন আর নেই। 

 

  • প্রশ্ন: যদি একজন রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখেন, তাহলে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গান নিয়ে কী বলবেন?

রাজশ্রী: সেক্ষেত্রে বলব, বন্যাদির মতো সুরবদ্ধ কণ্ঠ খুব বেশি শিল্পীর নেই। অসম্ভব সুরে গান তিনি। রবিঠাকুরের গানের সুর এবং গায়কি অক্ষুণ্ণ রেখেই গান করেন। যাকে ইংরেজিতে বলে ‘ট্র্যাডিশনাল’, অর্থাৎ পরম্পরাগত ধারা তাঁর গানে সম্পূর্ণ রূপে থাকে। এক বিন্দু নড়ে চড়ে যান না তিনি। শুদ্ধ কণ্ঠ, শুদ্ধ সুর। আর যে কথা বলার, তা হল ‘ভয়েস থ্রো’, বা কথার ‘ডেলিভারি’— এটি অসম্ভব পরিশীলিত, মার্জিত। কখনও কানে আঘাত করে না তাঁর কণ্ঠ। পাশাপাশি এই বন্যাদি যখন স্বদেশ পর্যায়ের গান গাইছেন, তখন এই গলাতেই খেলছে দাপট। পাশাপাশি গানের বোধ এবং গানের ভাবের উপর তাঁর অসাধারণ দখল। সব কিছুর চমৎকার ভারসাম্যের কারণেই তিনি এত বড় মাপের এক শিল্পী। 

 

  • প্রশ্ন: ওঁকে আপনি ব্যক্তিগত ভাবে চেনেন। মানুষ হিসাবে কেমন দেখেছেন তাঁকে?

রাজশ্রী: কলকাতায় উনি যখন থাকেন, বেশ কয়েক বার ওঁর কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। কখনও মনে হয়নি, কোনও দূরের মানুষের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছে। বাড়িতে উনি একেবারে আমাদের চেনা এক বাঙালি মেয়ে। কথা বলতে কখনও অসুবিধা হয় না। সহজে কথা বলা যায়, এমন একজন মানুষ উনি। সাধারণত্ব এবং অসাধারণত্বের এক চমৎকার মিশ্রণ আছে ওঁর মধ্যে। 

 

  • প্রশ্ন: রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা এই সম্মান পাওয়ায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের বা রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রে কোনও প্রভাব পড়বে কি?

রাজশ্রী: (একটু থেমে)। না। পড়বে না। উত্তরটা হয়তো পছন্দ হল না। কিন্তু একটি কথা পরিষ্কার করে বুঝে নেওয়া দরকার। যে শিল্প ক্লাসিক্যাল, অর্থাৎ যা কালোত্তীর্ণ— কোনও পুরস্কার বা সম্মান তার উপর নতুন কোনও প্রভাব ফেলে না। রবিঠাকুরের গান, তাঁর লেখা, তাঁর সৃষ্টি— এগুলির কোনও বিশেষ পুরস্কার বা সম্মানের অবলম্বনের প্রয়োজন নেই। একজন শিল্পী কোনও একটি পুরস্কার পেলে বা সম্মান পেলে আমাদের নিশ্চয়ই ভালো লাগে। তাঁর জন্য আমাদের গর্ব হয়। কিন্তু সেটি কালজয়ী সৃষ্টিকর্মের উপর প্রভাব ফেলে না। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিজের শক্তিতেই বেঁচে থাকবে, এবং এগিয়ে যাবে। 

 

  • প্রশ্ন: শেষ প্রশ্ন। অনেকে অভিযোগ তোলেন, কেন্দ্রে যে সরকারই থাকে, পদ্মসম্মান তারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রদান করে এবং তার থেকে সুবিধা তোলার চেষ্টা করে। রাজনৈতিক সচেতন মানুষ হিসাবে এবারের ঘটনাটি আপনি কীভাবে দেখেন?

রাজশ্রী: ‘একজন বাংলাদেশি শিল্পীকে পদ্মসম্মান দেওয়া হল’ বা ‘এমন একজন শিল্পী সম্মান পেলেন যিনি হিন্দু নন’— এসব কথা বলা এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক। অনেকে হয়তো নিজেদের এমন পরিচয় দিয়ে, তা থেকে কিছু সুবিধাও পেতে চান। ওই পরিচয়গুলিকে বেশি করে সামনে এনে প্রচারের আলোর সন্ধান পেতে চান তাঁরা। এক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই তা নয়। বন্যাদি ভারতীয় নাকি বাংলাদেশি, বন্যাদির ধর্ম কী— এই আলোচনার কোনও অর্থ এক্ষেত্রে নেই। একজন যোগ্য শিল্পী হিসাবে ওঁকে এই সম্মান দেওয়া হয়েছে। তার পিছনে কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে কি না, তা জানা নেই। তাই সে আলোচনায় না গিয়েই তাই বলতে পারি, সঠিক মানুষ সম্মান পেয়েছেন। আজ যদি অন্য কোনও রাজনৈতিক দল কেন্দ্রে থাকত, বা অন্য কোনও দলের সরকার যদি ওঁকে অন্য কোনও সম্মান দেয়— তাহলেও আমি একই কথাই বলব। এর কোনও ব্যত্যয় হবে না।