কী হতে যাচ্ছে ইউক্রেনের জনপ্রিয় সেনাপ্রধানের ভবিষ্যৎ

ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল ভ্যালেরি জালুঝনি কি দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখবেন? মস্কোর আক্রমণকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ইউক্রেনে তাকে জাতীয় বীরের মর্যাদা দেওয়া হয়। কিন্তু এসব কিছুই ছাপিয়ে এখন একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে-আর তা হলো, জালুঝনি কি পদে থাকছেন? ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।

চলতি সপ্তাহে পশ্চিমা ও ইউক্রেনীয় সংবাদমাধ্যমের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সপ্তাহেই তাকে দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার অনুরোধ করেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তবে সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। 

এই বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র বুধবার রয়টার্সকে জানিয়েছে, স্থলবাহিনীর কমান্ডার কর্নেল জেনারেল ওলেক্সান্ডার সিরস্কিকে জালুঝনির দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনিও তা প্রত্যাখ্যান করেন।

সত্যিই সিরস্কিকে এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল কি না, ইউক্রেনের জেনারেল স্টাফ ও প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে সেই প্রশ্নেরও কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। 

ইউক্রেনের সেনাবাহিনী এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আর সেই লড়াইয়ে তারা যে খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না, তা এখন স্পষ্ট।

পশ্চিমাদের কাছ থেকে পাওয়া সামরিক ও আর্থিক সহায়তাও দিন দিন কমে আসছে। ফলে রাশিয়ার অবিরাম ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মুখে কিয়েভের শক্তি নষ্ট হচ্ছে। যুদ্ধক্ষেত্রের এমন অবস্থা শুধু জালুঝনিকেই নয়, বরং তার জনপ্রিয়তা ও প্রমাণিত দক্ষতাকেও হুমকির মুখে ফেলছে। আর সেকারণেই যুদ্ধক্ষেত্রে নতুন মোড় আনতে তার পরিবর্তে অন্য কাউকে চাইছে কিয়েভ।

অনেকের কাছে বীর

জালুঝনির নেতৃত্বে অপ্রতিরোধ্য প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে, যুদ্ধের শুরুর দিকে ইউক্রেনের সেনারা গেপানীয়তা ও গতি ব্যবহার করে কিয়েভ দখলে রাশিয়ার অগ্রগতি ঠেকিয়ে দিয়েছিল। আর তা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেন জয়ের আশা যে সুদূর পরাহত, তা নিশ্চিত করেছিল।

যুদ্ধের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে জালুঝনির সাফল্যের ভাণ্ডার বেড়েছে। উত্তরপূর্ব ও দক্ষিণে পাল্টা আক্রমণ শুরুর পর থেকে রুশ বাহিনীর দখলে থাকা বিপুল পরিমাণ ভূমি পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছিল তার বাহিনী, যা এক অসম্ভাব্য বিজয়ের আশা জাগিয়েছিল। যার ফলে দেশে-বিদেশে প্রশংসা অর্জন করেছিলেন তিনি।

দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খেরসন দখলমুক্ত করার পর, দেয়ালে দেয়ালে তার হাসিমাখা প্রতিকৃতি আঁকা হয়। লেখা হয় ‘ঈশ্বর ও জালুঝনি আমাদের সঙ্গে আছেন’।   

এরপর থেকেই যেন ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রের গতি স্থবির হয়ে পড়ে। তবে জরিপ বলছে, গত বছর পর্যন্ত জালুঝনির প্রতি ইউক্রেনের ৯২ শতাংশ মানুষের আস্থা রয়েছে। আর জেলেনস্কির প্রতি আস্থা রয়েছে ৭৭ শতাংশের, যা জালুঝনির চেয়ে কম।

নভেম্বরে ইকোনমিস্ট এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে যুদ্ধক্ষেত্রে অচলাবস্থা বিরাজ করছে বলে মন্তব্য করেন জালুঝনি। মূলত: তারপর থেকেই জেলেনস্কির আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যেতে থাকে। যদিও চার-তারকা বিশিষ্ট জেনারেলের যুক্তি ছিল–উন্নত প্রযুক্তিই হতে পারে অচলাবস্থা ভাঙার চাবিকাঠি। তখন থেকেই তাকে বরখাস্তের গুঞ্জন শুরু হয়।   

যদি তাকে অপসারণ করা হয় এবং যদিও তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই–তারপরও যদি তিনি রাজনীতিতে আসেন– তাহলে অবশ্যই এই জেনারেল হবেন যে কারও শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী। 

বলিষ্ঠ ‘স্বেচ্ছাসেবক’

ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর, ১৯৯০-এর দশকে জালুঝনি সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু করেন। স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর তার পদোন্নতি ঘটে।

২০১৪ সালে পূর্ব ইউক্রেনের একটি এলাকায় ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে কাজ করাকালীন রুশ সমর্থিত বিছিন্নতাবাদীরা ওই এলাকা দখল করেছিল, আর তখনই যুদ্ধের বাস্তবতা সম্পর্কে প্রথম হাতেখড়ি হয় তার।

সামরিক বাহিনীতে জালুঝনিকে সবাই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবেই চিনতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে স্থানীয় কমান্ডারদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুমতি দেওয়ার জন্য সুনাম রয়েছে তার। সোভিয়েত সামরিক প্রথাগুলো পছন্দ করতেন না তিনি। তখন তিনি ছিলেন ইউক্রেনের পুরনো সোভিয়েত ধাঁচের জেনারেলদের মাঝে এক নতুন হাওয়া। 

২০২২ সালের শেষের দিকে রাশিয়া যখন খারকিভ ও খেরসন অঞ্চলে পরাজিত হওয়ার পর দখলকৃত অঞ্চলগুলোতে পরিখা খনন ও মাইন পুঁতে প্রতিরক্ষা জোরদার করে রাশিয়া। গত বছর ইউক্রেন ভূখণ্ড দখলে পাল্টা আক্রমণ শুরু করলে রুশ বাহিনী তা প্রতিহত করে কিয়েভের সেনাদের অগ্রগতি ঠেকিয়ে দেয়।

উভয়পক্ষেরই হাজার হাজার সেনা নিহত ও আহত হয়েছেন। যদিও এর সরকারি কোনও নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু ইউক্রেনের প্রয়োজন ছিল কয়েক লাখ সেনা। সেনাবাহিনীর চাহিদা মতো সরকার পাঁচ লাখ সেনা নিয়োগে ব্যর্থ হয়।

এছাড়া পশ্চিমা সমর্থন বজায় রাখতেও সংগ্রাম করছে কিয়েভ। যুদ্ধ চালিয়ে যেতে যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এদিকে গত দুই মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, ত্রাণ ও সামরিক সহায়তা সরবরাহে ব্যর্থ হয়েছে।  

এই সবকিছুর একটা অর্থই দাঁড়ায়–আর তা হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে চলমান সবচেয়ে মারাত্মক সংঘাত এখন তৃতীয় বছরে প্রবেশ করছে, যেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো জালুঝনি’র পক্ষে বেশ কঠিনই হবে।