প্রশ্নবিদ্ধ পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা

ব্যাপক সহিংসতার মধ্যেই বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠেয় এই নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারছেন না দেশটি গত নির্বাচনে জয়ী হওয়া পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের নেতা ইমরান খান। নির্বাচনে তার দল অংশ নিলেও আগের প্রতীক পাচ্ছে না তারা। ভোটের লড়াইয়ে রয়েছেন আদালত কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অযোগ্যঘোষিত নওয়াজ শরিফ। এমন পরিস্থিতিতে দেশটির প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ডন-এ নির্বাচনি ব্যবস্থার সমালোচনা করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের নির্বাচন ব্যবস্থা যেন প্রকৃত প্রতিনিধিত্বের বিভ্রম।

ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন (ইসিপি), তত্ত্বাবধায়ক সরকার, প্রাদেশিক সরকারগুলো–বিশেষ করে পাঞ্জাব সরকার এবং বিচারব্যবস্থা (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া)– সবাই মিলে এক নির্লজ্জ কৌশল অবলম্বন করছে। আর এতে সমর্থন রয়েছে স্টাবলিশমেন্ট হিসেবে পরিচিত দেশটির সেনাবাহিনীর। জনগণের চোখের সামনেই এসব কৌশল বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কেউ দেখতে চাইলেই দেখতে পারবে।

প্রতিবেদনে, দেশটির প্রধান একটি রাজনৈতিক দল, পিটিআইকে আনুষ্ঠানিকভাবে আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করার সমালোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, নজিরবিহীনভাবে দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে এক সপ্তাহে পরপর তিনটি ভিন্ন ভিন্ন মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। ফলে আসন্ন নির্বাচনটিও পাকিস্তানি জনগণের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির আরেকটি প্রতিনিধিত্বহীনতার প্রকাশ ঘটাবে।

২০২২ সালের এপ্রিলের আগে পরে যেভাবে দেশটির রাজনৈতিক দলগুলো ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান পিটিআইর বিরুদ্ধে কাজ করেছে, তা অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচনি ব্যবস্থার লঙ্ঘন।

এছাড়া ২০২৩ সালের ৯ মে’র সহিংসতার ঘটনাকে এখনও স্বাধীনভাবে তদন্ত এবং যাচাই করা হয়নি। শুধু পিটিআইকে ভিকটিম বানানো হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুসারে, গত ৫৩ বছরে দেশটিতে অনুষ্ঠিত ১১টি সাধারণ নির্বাচনের ৬টিতেই গড় ভোটার উপস্থিতি ছিল মাত্র ৪৫ শতাংশ। এর অর্থ হলো, দেশটির অর্ধেকের বেশি ভোটদানে যোগ্য ভোটার তাদের মত প্রকাশ করেননি। যা নির্বাচনি ব্যবস্থা ও ফলাফলের ক্রমাগত অসঙ্গতির একটি প্রধান কারণ। অন্য ৫টি নির্বাচনে ভোট ৫০ শতাংশের বেশি হলেও তা কখনোই দুই-তৃতীয়াংশ বা তার বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পৌঁছাতে পারেনি। অথচ একটি নির্বাচনকে প্রতিনিধিত্বমূলক বলার জন্য অন্তত ৭৫ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি থাকা উচিত। বেশিরভাগ গণতান্ত্রিক দেশে সংবিধান পরিবর্তনের জন্য এমন সমর্থন প্রয়োজন হয়।

প্রতিবেদনে পাকিস্তানে ভোটার উপস্থিতি কম থাকার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, নির্বাচনি ব্যবস্থার ন্যায়পরায়ণতার প্রতি বিশ্বাসের অভাব, ভোটকেন্দ্রের দূরত্ব, ভোটকেন্দ্র বা আশপাশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ভোটারদের উদাসীনতা, প্রার্থীর প্রতি আস্থার অভাব, নারীদের মধ্যে কুসংস্কার ইত্যাদি।

‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতি

পাকিস্তানের নির্বাচন ব্যবস্থা বেশিরভাগ সময় প্রতিনিধিত্বমূলক না হওয়ার প্রধান কারণ হলো ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ (এফপিটিপি) পদ্ধতির ব্যবহার। এটি এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে একজন প্রার্থী তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে একটি ভোট বেশি পেলেও তাকে বিজয়ী হিসেবে গণ্য করা হয়। তাত্ত্বিকভাবে, কোনও প্রার্থী মাত্র দুই ভোট পেয়েও জয়ী হতে পারবেন, যদি তার প্রতিদ্বন্দ্বী কেবল একটি ভোট পান। জয়ী হওয়া প্রার্থী তখন তার আসন বা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হয়ে যান। অথচ দেখা যায়, তিনি হয়তো মোট ভোটারের মাত্র ২৫ শতাংশের ভোট পেয়েছেন। বিরোধী প্রার্থী হয়তো পেয়েছেন ২২ শতাংশ। ফলে দেখা যায়, ওই এলাকার অর্ধেক ভোটারের ভোট না পেয়েও তিনি সবার প্রতিনিধি হয়ে যান।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা চলে গেলেও রেখে গেছে তাদের এই নির্বাচনি ব্যবস্থা। যা থেকে উপমহাদেশের মানুষ বা এই অঞ্চলের দেশগুলো এখনও বের হতে পারেনি।

এফপিটিপি পদ্ধতির আরেকটি অসঙ্গতি হলো, প্রাপ্ত আসন সংখ্যা প্রাপ্ত ভোটের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে। যেমন: প্রতিবেশী ভারতে ২০১৯ সালে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি মাত্র ৩৭.৩৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। এনডিএ জোট পেয়েছিল ৪৫ শতাংশ ভোট। তবু লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ৩৫৩ আসনের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল বিজেপি। পাকিস্তানেও এ ধরনের ঘটনার বহু উদাহরণ রয়েছে।

এগিয়ে যাওয়ার পথ

পাকিস্তানের ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনি ব্যবস্থা সংশোধনের দুটি উপায় রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের জন্য ভোটদান বাধ্যতামূলক করা।

বাধ্যতামূলক ভোটদান প্রতিটি নাগরিককে মনে করিয়ে দেয় যে তারা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বাস করেন এবং ভোটদানের মাধ্যমে মৌলিক দায়িত্ব পালন করছেন। আয়কর দেওয়ার মতোই এটি হবে একটি মৌলিক দায়িত্ব।

নির্বাচনকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের সত্যিকারের প্রতিনিধিত্ব করার দ্বিতীয় ধাপ হলো, একটি নির্দিষ্ট নির্বাচনি এলাকায় বিজয়ী প্রার্থীর জন্য সব নিবন্ধিত ভোটের ন্যূনতম ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেতে হবে। অর্থাৎ মোট নিবন্ধিত ভোটারের অর্ধেকের বেশি ভোট পেলে তিনি বিজয়ী হবেন। একমাত্র তখনই তিনি প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন।