সাভার গোলাপ গ্রামে ধুম পড়েছে গোলাপ বিক্রির, লক্ষ্যমাত্রা ৩৯ কোটি

ঢাকার সাভারে লাল টুকটুকে ভালোবাসার স্নিগ্ধতা মেশানো স্বপ্নরাজ্য বিরুলিয়ার গোলাপগ্রাম। যেখানে শত শত হেক্টর জমিতে ফুটে আছে ভালোবাসার লাল গোলাপ। এসব গোলাপ ভালবাসা দিবসের জন্য পরম আদরে প্রস্তুত করেছে গোলাপ গ্রামের ফুল চাষিরা।

এক দিন পরই বিশ্ব ভালবাসা দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও বেশ ঘটা করেই পালিত হবে দিবসটি। আর লাল টুকটুকে গোলাপ ছাড়া ভালবাসা দিবস উদ্‌যাপন তো কল্পনাই করা যায় না। গোলাপ দিয়েই দিবসটিতে অনেকেই ভালবাসা নিবেদন করবেন প্রিয়জনকে। তাই ফুল উৎপাদনে চেষ্টার যেন কমতি ছিল না গোলাপ চাষিদের।

মঙ্গলবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) সকালে বিরুলিয়ার গোলাপ গ্রামে গিয়ে চাষির সাথে কথা বলে জানা যায়, ভালবাসা দিবস ছাড়াও পাশাপাশি আরও বেশ কয়েকটি দিবস রয়েছে। যেমন পহেলা ফাল্গুন, ২১ ফেব্রুয়ারি ও পহেলা বৈশাখ। সারা বছরের মধ্যে এই সময়েই ফুলের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। চাষিরা তাই এই সময়টাকেই ফুল বিক্রির সেরা মৌসুম মনে করে থাকেন। তাই এই সময়কে প্রাধান্য দিয়ে বাগানে বাড়তি পরিচর্যা করেন গোলাপ চাষিরা। আর সে কারণেই দৃষ্টিজুড়ে শুধু লাল টুকটুকে গোলাপ আর গোলাপ।

ব্যস্ততা বেড়েছে গোলাপ চাষিদের: ভালবাসা দিবস, পহেলা ফাল্গুন, ২১ ফেব্রুয়ারি ও পহেলা বৈশাখ সামনে রেখে যেন দম ফেলানোর ফুরসত নেই গোলাপ চাষিদের। বাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। বাগান পরিচর্যায় অনেকেই নিয়োগ করছেন দিনমজুর। কেউ পরিস্কার করছেন বাগানের আগাছা, কেউ বাগান থেকে অপসারণ করছেন রোগা ফুল গাছ, কেউবা গোলাপের বাগানে দিচ্ছেন সার বা কীটনাশক। আবার কেউ বাগান থেকে ফুল সংগ্রহ করে বাজারজাত করতে ব্যস্তসময় পার করছেন। এছাড়া চুরি রোধে রাতের পর রাত জেগে বাগান পাহারা দিচ্ছেন গোলাপ চাষিরা।

গোলাপ গ্রামের চাষিরা জানান, ছত্রাক ও করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জোরালো প্রচেষ্টা করছি আমরা। এইবারও অনেকের বাগানে ছত্রাকের সংক্রমণ হয়েছে। ফুল পঁচে ঝড়ে পরেছে। তবে বেশিরভাগ বাগানেই ফুলের ভাল ফলন হয়েছে। আমরা ভালবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে টার্গেট করে ফুল বাগানের পরিচর্যা করেছি। আশা করি বাজার ভাল পাবো। তবে বাজারে প্লাস্টিকের ফুলের সাথে আমরা পারছি না। আমাদের পুরো বাজার নষ্ট করে দিচ্ছে প্রাস্টিকের ফুল।

এসব ফুল আমদানি বন্ধ না করা হলে ধীরে ধীরে ফুল চাষিরা হুমকির মুখে পড়বে। এবছর ফলন ভালো হওয়ায় গোলাপের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এবার ফুলের দাম একটু বেশি পাওয়া যাচ্ছে।

গোলাপ চাষি ওহাব বলেন, আজ প্রতি পিছ গোলাপ বিক্রি হচ্ছে ৩০/৪০ টাকায়। আগামীকাল বুধবার) বেড়ে প্রতি পিছ ফুলের দাম হতে পারে ৫০/১০০ টাকা। এবার আমরা গত কয়েক বছরের লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারবো বলে আশা করছি।

দর্শনার্থীরা বলেন, আমরা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ফুলের টানে গোলাপ রাজ্য বিরুলিয়াতে ঘুরতে এসেছি। আসলে এতো গোলাপ আর এতো ফুল আমরা কিন্তু কোথাও একসাথে দেখি না। সত্যিই যেন একটা ফুলের রাজ্য। শহরের কৃত্রিমতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে এখানে সবারই একবার হলেও আসা উচিত।

একমি ঔষধ কোম্পানিতে কর্মরত শ্রাবণী আক্তার নামে ঘুরতে আসা এক দর্শনার্থী বলেন, এখানে অনেক দূরদূরান্ত থেকে গোলাপের টানে আসে মানুষ। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের পদচারণা এখানে। তাদের মধ্যে নারীই বেশি। কিন্তু নারীদের জন্য একটা ওয়াশরুমও নেই। যেহেতু এখানে আমাদের মত অনেক লোকই আসেন এবং যাওয়ার সময় গোলাপ ক্রয় করে নিয়ে যান। ক্রেতা ভেবেও নারীদের জন্য এটা করা উচিত। এছাড়া সব ঠিক ছিল, নিরাপত্তার সেরকম ব্যবস্থা না থাকলেও এই অঞ্চলের মানুষ অনেক ভাল এবং সহায়ক। সর্বোপরি এখানে এসে অনেক ভাল লেগেছে। ফুলের রিং মাথায় দিয়ে অনেক অনেক ছবি ও সেলফি তুলেছি।

রাজধানীর উত্তরা থেকে বিক্রির উদ্দেশ্যে ফুল ক্রয় করতে এসেছেন ফুল ব্যবসায়ী জামাল তিনি বলেন, আমাদের ফুলের দোকান রয়েছে। দোকানের জন্য আজ ফুল কিনতে এসেছি ভালবাসা দিবস উপলক্ষ্যে। আমরা শাহবাগ থেকে ফুল আগে কিনতাম। কিন্তু এখন পাশেই বাগানের তাজা ফুল পাচ্ছি। তাই সরাসরি বাগান থেকে ফুল সংগ্রহ করছি। এখানে তুননামুলক কম দামে ফুল পাওয়া যায়। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী আমরা ফুল সংগ্রহ করছি। তবে গত বছরের তুলনায় এবার ফুলের দাম বেড়েছে প্রতি পিছে প্রায় ১০ টাকা। আগে ১৫/১৮ টাকায় আমরা গোলাপ ফুল পেতাম। এবার তা বেড়ে দাড়িয়েছে ২৫/৩০ টাকা।

গোলাপ গ্রামে যত ফুল: নাম গোলাপ গ্রাম হলেও সময় ও চাহিদার সাথে সাথে আরও বেশ কয়েকটি প্রজাতির ফুল এখানে উৎপাদন শুরু হয়েছে। প্রায় ৫০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হচ্ছে জারবেরা। এছাড়া সাদা গোলাপ, হলুদ গাঁদা, জিপসি, গ্লাডিওলাস, রজনিগন্ধা, ক্যালেন্ডিয়া, মাম্প, জিনিয়া, চন্দ্রমল্লিকাসহ আরও বেশ কিছু প্রজাতির ফুল চাষ হচ্ছে এখানেই। গোলাপের মধ্যে রয়েছে- চায়না গোলাপ, মিরিন্ডা গোলাপ, ইরানি গোলাপসহ বেশ কয়েক প্রজাতির গোলাপ।

এবিষয়ে সাভার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোছা: শারমিন সুলতানা বিডি২৪ লাইভ ডটকম কে বলেন, সাভার উপজেলা কৃষি জানান, বিরুলিয়ার গ্রামগুলোর প্রায় ৩০৫ হেক্টর জমিতে বছরজুড়ে গোলাপের বাণিজ্যিক চাষ হয়। তাই গোলাপগ্রাম নামেই খ্যাত এ ইউনিয়ন। দেশের বেশিরভাগ চাহিদা পূরণ হয় এখানকার ফুলে। আর ফেব্রুয়ারিতে নানা দিবস কেন্দ্র করে চাহিদার সঙ্গে ফুলের দাম বাড়ে কয়েকগুণ। তাই এ সময়টা বেশি মুনাফার আশায় থাকেন চাষিরা।

এ বছর ৩৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকার ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রার পাশাপাশি ভালো মুনাফার আশা সাভারের ফুলচাষিদের। যা গত বছর ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল প্রায় ২০ কোটি টাকা। এক বছর পরই লক্ষ্যমাত্রা বেড়ে দাড়িয়েছে প্রায় দ্বিগুণ।

উল্লেখ্য: যে-সব গ্রাম জুড়ে বিস্তৃত গোলাপ গ্রাম:১৯৮৯ সালে বিরুলিয়ার সাদুল্লাপুর গ্রামে সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভাবে গোলাপ চাষ শুরু হলেও এখন ইউনিয়নের ১৫/২০ টি গ্রামে প্রায় দেড় হাজার চাষি লাভজনক বাণিজ্যিকভাবে গোলাপের চাষ করছেন।



সালাউদ্দিন/সাএ