‘বউয়ের টাকায় সংসার চালাতে হলে খেলে কী হবে’

হঠাৎ করে জাতীয় দল থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন রোমান সানা। গত মাসের ৭ তারিখেই ফেডারেশনকে চিঠি দিয়ে নিজের কর্মস্থল আনসারে চলে গেছেন। আজ অবসরের ঘোষণা জানাজানি হতেই চারদিক থেকে অনুরোধও পাচ্ছেন আর্চারির পোস্টার বয়-‘ফিরে এসো রোমান।’

তবে রোমান নিজের সিদ্ধান্তে অটল। ফিরতে পারেন যদি পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা সেভাবে দেওয়া হয়। এ নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের কাছে আরও বিস্তারিত কথা বলেছেন খুলনা থেকে উঠে আসা ২৮ বছর বয়সী আর্চার..

বাংলা ট্রিবিউন: হঠাৎ করে অবসর। জানাজানির পর আজ নিশ্চয়ই অনেক ফোন পেয়েছেন?

রোমান সানা: তা তো পাচ্ছিই। এখনও আপনার সঙ্গে কথা বলছি ফোন আসছেই। তবে সবার ফোন তো ধরা সম্ভব হচ্ছে না। যতটুকু পারছি, ধরছি।

ফোন করে সবাই কী বলছে?

রোমান: কাছের মানুষেরা ফোন করছে। আমার কর্মস্থল বাংলাদেশ আনসারের সতীর্থ ও স্যাররা আমাকে বকাঝকা করেছে। সবাই বলছে ফিরে আসতে। যেন এমন সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসি। তারা বলছে, ‘আর্চারির জন্য তোমাকে দরকার আছে। তুমি ফিরে আসো।’ এসব আর কী!

তাহলে কি সিদ্ধান্ত পুনর্ববিচেনা করবেন?

রোমান: করতে পারি। তবে আমার বেশ কিছু শর্ত আছে।

কেমন শর্ত?

রোমান: আমাকে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। যেন জীবন-সংসার নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে না হয়।

আরও একটু খুলে বলবেন?

রোমান: আমি বিয়ে করেছি, এটা তো সবাই জানেন। বউ নিয়ে টঙ্গীতে আলাদা বাসা নিয়ে সংসার পেতেছি। সেখানে ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে আমার অনেক টাকা ব্যয় হয়। সংসার হলে সবার যা হয়। কিন্তু আমি আর্চারি থেকে মাসে পাই মাত্র ৩০ হাজার টাকা। ফেডারেশন থেকে ৫ ও আনসার থেকে ২৫ হাজার। এই টাকা দিয়ে এই বাজারে কীভাবে আমি সংসার চালাবো? আপনি বলেন..

এমনও হচ্ছে মাস শেষ হওয়ার আগেই বউ (দিয়া সিদ্দিকী) এর কাছ থেকে টাকা নিয়ে সংসার চালাতে হচ্ছে। পুরোপুরি হিমশিম খেতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়। আমার পরিবারে আরও অনেকে আছেন। মায়ের ওষুধসহ অনেক টাকা প্রয়োজন হয়। এখন আমি খেলবো নাকি এসব চিন্তা করবো। আগে একা ছিলাম। কোনোমতে মানিয়ে নিয়েছি। এখন আর পারছি না।

তাহলে ভেবে চিন্তে অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন..

রোমান: হ্যাঁ, তাই তো। এছাড়া তো কিছু করার নেই। একটু আগে  তো ব্যাখ্যা দিলামই।

কিন্তু কেউ কেউ বলছে আপনার পারফরম্যান্স অনেক দিন ধরে খারাপ যাচ্ছে। আপনাকে দিয়ে কিছু হবে না। তাই সুযোগ বুঝে আপনি অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আসলে কতটুকু সত্যি?

রোমান: কে বলেছেন বলতে পারবেন? যেই বলুক তার ধারণা শতভাগ ভুল। রোমান সানা এতদিন ধরে খেলে আসছে নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে। কারও দয়াতে নয়। তবে পারফরম্যান্স হেরফের হতেই পারে। আমি এখনও বলছি এই রোমান সানা আরও ১০ বছর দেশকে সার্ভিস দিতে পারবে। তার আগে সুযোগ সুবিধাগুলো নিশ্চিত করতে হবে। যদি তা করা হয়। তাহলে আমি দেখিয়ে দেবো। আবারও নিজের যোগ্যতা দিয়ে অলিম্পিকে খেলবো। এমনকি পদকও জিততে পারি! তবে এর জন্য দীর্ঘ সময়ও লাগবে।

ফেডারেশন থেকে কেউ কিছু বলেনি..

রোমান: নাহ, এখনও কেউ কিছু বলেনি। এমনকি চপল স্যারও (কাজী রাজীব উদ্দিন, ফেডারেশন সাধারণ সম্পাদক) ফোন কিংবা সামনাসামনি কিছু বলেননি। চিঠি দেওয়ার পর তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। কিন্তু তিনি আমাকে এ নিয়ে কিছুই বলেননি। অন্যরাও তাই। এমনকি ক্যাম্পে থাকা আর্চাররাও কিছু বলেনি!

আর্চারি খেলে দেশ থেকে সেভাবে কিছু পাননি বলে সবসময় অভিযোগ করে থাকেন..

রোমান: সত্যি তো, আমি কী পেয়েছি বলুন। এসএ গেমসে মাবিয়া আক্তার সীমান্ত সোনার পদক পেয়ে ঢাকায় ফ্ল্যাট পেলো। মাহফুজা শীলা ও শাকিল আহমেদরাও তাই। আর আমি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে পদক পেলাম। দেশের নাম পুরো বিশ্বব্যাপী উজ্জ্বল করলাম। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে এসএ গেমসসহ আমার ২৬টি পদক রয়েছে। এর মধ্যে সোনার পদকও কম নয়। এত পদকের পরও  আমার ঢাকায় বা কোথাও স্থায়ী জায়গা নেই। অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো নয়। এসব চিন্তা করে জাতীয় দলে খেলাটা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যা করেছি বুঝেশুনেই করেছি।

‘বউয়ের টাকায় সংসার চালাতে হলে খেলে কী হবে’

জাতীয় দল থেকে অবসরের পর এখন কী করবেন। শুনেছি খুলনাতে মাছের ঘেরের ব্যবসা করতে চাইছেন..

রোমান: কিছু তো একটা করবো। ভালোভাবে বেঁচে থাকতে হলে তো কিছু একটা করতে হবে। এছাড়া তো উপায় নেই। তবে এভাবে সংসার জীবন চলে না। প্রতি মাসেই যদি বউয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলতে হয়, তাহলে কেমন দেখায় বলেন তো!

আপনার স্ত্রী দিয়া সিদ্দিকী তো দেশের আর্চারির অন্যতম মুখ। অবসর নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া কেমন..

রোমান: ও তো সবকিছুই আগে থেকে জানতো। এখন তো পুরোপুরি বুঝতে পারছে। ওর মৌন সমর্থন আছে। ও আমার পাশেই আছে। যেই আমি অনুশীলনে আসতাম সিএনজি অটোতে করে, বিয়ের পর এখন আমাকে পাবলিক বাসে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে আসতে হয়। তাহলে বুঝুন কী অবস্থা আমার। ৩০ হাজার টাকা দিয়ে তো সংসার চালানো যায় না। বেশ কঠিন..।

কোচের সঙ্গে রোমান

মার্টিন ফ্রেডরিক আপনার এমন সিদ্ধান্তে কী বলেছেন?

রোমান: কোচ অনেক রাগ করেছেন। অভিমান করে আমার সঙ্গে কথাই বলছেন না। আসলে উনি আমাকে নিজের ছেলের মতো মনে করেন। আমার এমন সিদ্ধান্ত উনি মানতে পারছেন না। উনি চান যেন আমি আরও খেলি। কিন্তু কী করবো বলুন!

তাহলে দেশবাসী তথা ক্রীড়াঙ্গন টোকিও অলিম্পিকে সরাসরি জায়গা করে নেওয়া রোমান সানাকে সত্যি হারাতে যাচ্ছে?

রোমান: আপাতত তাই। এছাড়া আমার কোনও বিকল্প ছিল না। কী করবো বলুন। অনেক তো হলো। এক যুগের বেশি সময় ধরে দেশকে সার্ভিস দিচ্ছি। বিনিময়ে কী পাচ্ছি। আনসারের চাকরিতে নেই পদোন্নতি। জাতীয় দলে খেলে অর্থও নেই সেভাবে। তাহলে আমার মতো একজন ক্রীড়াবিদের যদি এই অবস্থা হয় তাহলে অন্যরা কেমন আছে একবার ভাবুন।

আপনার ভবিষ্যত নিয়ে আগাম শুভকামনা জানাই।

রোমান: ভবিষ্যতে কী হবে আমি জানি না। তবে এই অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। দেওয়া ঠিকও না। আমি চাই, একজন ক্রীড়াবিদ যারা দেশের হয়ে খেলে থাকে, পদকও নিয়ে আসে, তাদের অন্তত আরও ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তাহলেই না দেশকে তারা আরও পদক নিয়ে এসে দিতে পারবে।