চায়ের শহরে শুরু ডালাসের ড্রেস রিহার্সেল

দুটি পাতা একটি কুঁড়ির শহর সিলেট। দেশ-বিদেশে চায়ের ঘ্রাণ ছড়িয়ে যাওয়া এই জেলায় শুরু হচ্ছে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যকার দ্বি-পাক্ষিক সিরিজ। ইদানিং ট্রফি উন্মোচনের জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) ঐতিহাসিক জায়গাগুলোকে বেছে নিচ্ছে। এবার চায়ের শহরে, চায়ের বাগানে উন্মোচিত হয়েছে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজের ট্রফি।

চা বাগানে আগেও একবার বিসিবি ট্রফি উন্মোচন করেছিল। মেয়েদের এশিয়া কাপে এশিয়ার অধিনায়করা মিলে সেটি করেছিলেন। যদিও ট্রফিটি ধরে রাখতে পারেনি নিগার সুলতানার দল। এবার নাজমুল হোসেন শান্তর দল কি পারবে এই ট্রফিটা ঘরে রাখতে? শান্তর ইতিবাচক মানসিকতা ম্যাচের আগে সেই ইঙ্গিত দিলেও লড়াইটা ২২ গজেই করতে হবে।

সোমবার সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে শুরু হচ্ছে তিন ম্যাচ টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচটি। শুরু হবে সন্ধ্যা ৬টায়। টি-স্পোর্টস, গাজী টেলিভিশন ছাড়াও বেশ কয়েকটি দেশে ম্যাচটি সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। তবে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি শুরুর আগে সিলেটের দর্শকদের নেই কোনও আগ্রহ। ভিড় নেই টিকিট কাউন্টারগুলোতে। রিক্সায় মাইকিং করে টিকিট বিক্রি করতে দেখা গেছে আয়োজকদের। সবমিলিয়ে দর্শকহীন মাঠে খেলা গড়ানোর শঙ্কা।

২০২৩ সালে ৩১ ডিসেম্বর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ দিয়ে বাংলাদেশ গত বছরটা শেষ করেছিল। বিপিএল শেষে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের দম ফেলার ফুসরত নেই। লঙ্কানদের বিপক্ষে সিরিজ দিয়েই শুরু হচ্ছে চলতি বছরে ক্রিকেটারদের আন্তর্জাতিক ব্যস্ত সূচি। আগামী জুন-জুলাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচটি ডালাসে অনুষ্ঠিত হবে ৮ জুন। সময়ের হিসেবে প্রায় ৩ মাস বাকি। তার আগে নিজেদের মাটিতে লঙ্কানদের বিপক্ষে প্রস্তুতিটা একটু আগে ভাগে সেরে নেওয়ার সুযোগ।

বাংলাদেশের অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত ও শ্রীলঙ্কার কোচ ক্রিস সিলভারউডের কণ্ঠেও মিললো তার আভাস। লঙ্কান কোচ বলেছেন, ‘আমরা বিশ্বকাপের মতো গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্টের আগে দাঁড়িয়ে। আমার ধারণা সবাই এখন তাদের দল চূড়ান্ত করে ফেলছে, দলের সদস্যদের অভিজ্ঞতার সুযোগ করে দিচ্ছে। ফলে বলাই যায়, আমরা বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতে আছি। তার আগে এমন একটা ভালো দলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দারুণ। ফলে রোমাঞ্চকর একটা সিরিজ প্রত্যাশা করছি।’

বাংলাদেশের অধিনায়ক শান্তও বলেছেন, ‘বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে আমরা ৮টা কি ১১টা ম্যাচ খেলবো। ম্যাচগুলো যদি প্রপার পরিকল্পনা নিয়ে খেলতে পারি, এখান থেকে গুছিয়ে নিয়ে যেতে পারি, তাহলে বিশ্বকাপের জন্য খেলাটা তুলনামূলক সহজ হবে।’

বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতে তিন ম্যাচের এই সিরিজ ভূমিকা রাখুক কিংবা না রাখুক। ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এই সিরিজ হারতে চাইবে না বাংলাদেশ। এমনিতেই দুই দলের ক্রিকেটারদের মধ্যে বন্ধুত্ব থাকলেও মাঠে ক্রিকেটে বৈরিতাও কম নয়। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা লড়াই মানে বাড়তি উত্তেজনা, যার শুরুটা হয়েছিল ২০১৮ সালে নিদাহাস ট্রফিতে। এরপর যতবার লঙ্কানদের বিপক্ষে বাংলাদেশ লড়াই করেছে, ততবারই উত্তেজনা আর রোমাঞ্চের ছিল ছড়াছড়ি। সর্বশেষ গত ওয়ানডে ওয়ানডে বিশ্বকাপে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজের টাইমড আউট কাণ্ডে দুই দেশের ক্রিকেটে এখনো গরম হাওয়া বইছে।

তাইতো নতুন আরও একটি ম্যাচ শুরুর আগে দুই দলের প্রতিনিধির কাছেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেওয়া হলো। শান্ত বলেছেন, ‘শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আসলে বাইরের বিষয়গুলো নিয়ে খুব একটা চিন্তা করছি না। আমার মনে হয় খুব ভালো একটা সিরিজই হবে। দুইটা দলই জেতার জন্য নামবে।’

অন্যদিকে, লঙ্কানরা অতীতের বিষয়গুলো মনে করতে চান না। তার মতে শুধু টি-টোয়েন্টি সিরিজেই নয়, সব ফরম্যাটে ফেভারিট হিসেবেই মাঠে নামবে শ্রীলঙ্কা, ‘প্রথমত, আমি আশা করছি দুই দলের মধ্যে খুব প্রতিযোগিতামূলক সিরিজ হবে। অতীতে যা হয়েছে, সেটা ইতিহাস, এখন তা চলে গেছে। দুই দলেই কিছু বিপজ্জনক খেলোয়াড় আছে। তাই আমি মনে করি দারুণ মজা হবে। অবশ্যই বলবো শ্রীলঙ্কাই ফেভারিট। তবে আমি আগেও বললাম, দুটি দলই ভালো যারা এই সিরিজ জেতার জন্য চেষ্টা করবে।’

শ্রীলঙ্কাকে এগিয়ে রাখার অবশ্য যথেষ্ট কারণ আছে। পরিসংখ্যান সেটাই বলছে। এখন অব্দি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৩টি টি-টোয়েন্টি খেলেছে বাংলাদেশ। যার মধ্যে ৪টি জিতেছে লাল-সবুজরা। দুই দলের সর্বশেষ লড়াই ২০২২ সালের এশিয়া কাপে। সেবার শ্রীলঙ্কা জিতেছিল ২ উইকেটে। তবে নিজেদের মাটিতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রেকর্ড ভালোই। সর্বশেষ তিনটি সিরিজই তারা জিতেছে।

বাংলাদেশ অবশ্য আরও একটি পরিসংখ্যানে এগিয়ে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে হিসেব করলে এখন পর্যন্ত খেলেছে ১৪ ম্যাচ, যার মধ্যে ১০টিতেই লাল-সবুজরা জিতেছে। তার মধ্যে ঘরের মাঠে ইংলিশদের হোয়াইটওয়াশের নজিরও আছে। শ্রীলঙ্কা এ সময় ১৩ ম্যাচ খেলে জয়ের দেখা পেয়েছে মাত্র ৫ ম্যাচে।

অতীত পরিসংখ্যান অবশ্য কোন দলকে ম্যাচ জিততে সহায়তা করবে না। তবে ভারপ্রাপ্ত থেকে শান্ত এখন ‘ভারমুক্ত’ হয়ে নিয়মিত অধিনায়ক। এর আগে ১১ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচে অধিনায়কত্বের অভিজ্ঞতা তার রয়েছে (ছয় ওয়ানডে, তিন টি-টোয়েন্টি ও দুই টেস্ট)। কিউই কন্ডিশনে তার নেতৃত্বে জয়ের অভিজ্ঞতাও আছে। শান্তর নেতৃত্বে নতুন দিনের শুরুটা দেখতে মুখিয়ে সবাই। তবে সিরিজ শুরুর আগে বাংলাদেশের প্রস্তুতিটা হয়েছে দারুণ। মাত্র দুই দিন আগেই বিপিএল শেষ করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাঠে নামতে প্রস্তুত শান্ত-হৃদয়রা।

বিপিএলে অধিনায়ক শান্ত সিলেট স্ট্রাইকার্সের হয়ে খুব ভালো করতে না পারলেও তার প্রমাণের কিছু নেই। এছাড়া লিটন দাস, সৌম্য সরকার, নাঈম শেখ, এনামুল হক বিজয়, তাওহীদ হৃদয়, মাহমুদউল্লাহরা দারুণ ক্রিকেট খেলেছেন। শেষ মুহূর্তে দলে সুযোগ পাওয়া জাকের আলী অনিক স্লগ ওভারে নিজেকে প্রমাণ করে সুযোগ পেয়েছেন। বল হাতে বিপিএলের সর্বোচ্চ উইকেট শিকার করেছেন শরিফুল। তাসকিন আহমেদও ভালো ছন্দেই আছেন। স্পিনে তাইজুল ইসলাম, রিশাদ হোসেন শক্তি বাড়িয়েছেন। এই অবস্থায় বাংলাদেশের সঙ্গে টেক্কা দিতে বিপিএলে সিলেট পর্বের ফুটেজ দেখবেন বলে জানিয়েছেন লঙ্কান কোচ, ‘উইকেটে সবুজ ঘাস দেখলাম। ফাস্ট বোলারদের জন্য ভালো। বল তো এখানে উইকেট কিপার পর্যন্ত ক্যারি করবে। বিপিএলে সিলেটের কিছু ম্যাচের ভিডিও ফুটেজ দেখবো। আমরা সৌভাগ্যবান যে এখানে খেলা কয়েকজন আছে আমাদের দলে।’

এদিকে, মুখে ইতিবাচক কথা বললেও শ্রীলঙ্কার ড্রেসিংরুমে অস্বস্তি আছেই! আম্পায়ারের সমালোচনা করে দুই ম্যাচ নিষিদ্ধ হেয়েছেন ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা। ট্রফি উন্মোচন করলেও শেষ টি-টোয়েন্টিতে তাকে পাওয়া যাবে। এছাড়া চোটের জন্য পুরো সিরিজে নেই পাথুম নিশাঙ্কা। দলে ডাক পেয়েও শেষ পর্যন্ত ছিটকে গেছেন কুশল পেরেরা। তার জায়গায় এখন দলে ফিরেছেন নিরোসান দিকবেলা। তারপরও অভিজ্ঞ ও তরুণদের সংমিশ্রণে  সিলেটের ২২ গজে লড়তে প্রস্তুত লঙ্কান দল।

দর্শকরাও উত্তেজনা আর রোমাঞ্চকর ম্যাচ দেখার অপেক্ষায়। সাম্প্রতিক সময়ে লঙ্কানদের বিপক্ষে যেমন উত্তেজনাকর ম্যাচ হচ্ছে, এমন কিছু হলে সিলেটের দর্শকরা উপভোগ্য একটি সিরিজ দেখার সুযোগ পাবে।