IPL 2024 Exclusive Lucknow Super Giants fast bowler Mayank Yadav is vegetarian being a devotee of Lord Krishna bowls fastest delivery in IPL

সন্দীপ সরকার, কলকাতা: বছর সাতেক আগের ঘটনা। নয়াদিল্লির সনেট ক্লাবের (Sonnet Club) ট্রায়ালে শীর্ণকায় ছেলেটিকে বল করতে দেখে চমকে উঠেছিলেন তারক সিনহা (Tarak Sinha), দেবেন্দ্র শর্মা-রা।

রোগাপাতলা ছেলেটির বল যে দেখতেই পাচ্ছে না ব্যাটাররা। বল হাত থেকে বেরচ্ছে, পিচে পড়ছে, সাঁ সাঁ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। এ ছেলে কি ম্যাজিক জানে নাকি! হাওয়ার ধাক্কায় পড়ে যেতে পারে, এত রোগা, অথচ বলে এত গতি! চমকে উঠেছিলেন তারক, দেবেন্দ্ররাও।

মনে করিয়ে দেওয়া যাক, তারকের জহুরির চোখ। তাঁর হাত ধরে সনেট ক্লাব থেকে ভারতীয় ক্রিকেট পেয়েছে একের পর এক তারকা। শিখর ধবন, ইশান্ত শর্মা, ঋষভ পন্থ, তালিকাটা বেশ লম্বা। সেদিন ট্রায়ালে দেখেও ভুল করেননি পোড়খাওয়া কোচ। সেই শীর্ণকায় ছেলেকেই তালিম দেওয়া শুরু হয়। বল করার জুতো ছিল না। কিনে দেওয়া হয় জুতো। লাইন-লেংথ নিয়ে পরিশ্রম করা হয়। আর শুরু হয় সাধনা।

যে অধ্যাবসায়ের ফল দেখা গিয়েছে আইপিএলে। সেদিনের সেই ছিপছিপে তরুণ লখনউ সুপার জায়ান্টসের জার্সিতে বাইশ গজে গতির আগুন জ্বালিয়েছেন। অভিষেক ম্যাচেই করেছেন চলতি আইপিএলের দ্রুততম বল। স্পিডোমিটার বলছে, সেই বলের গতি ছিল ঘণ্টায় ১৫৬.৮ কিলোমিটার। আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে, শন টেটের আইপিএলের ইতিহাসে করা দ্রুততম বলের রেকর্ডও কি ভেঙে দেবেন ময়ঙ্ক যাদব (Mayank Yadav)?

পাঞ্জাব কিংসের বিরুদ্ধে অভিষেক ম্যাচে ৪ ওভারে ২৭ রান খরচ করে তিন উইকেট নিয়েছেন ময়ঙ্ক। ম্যাচের সেরাও হয়েছেন। লখনউয়ের জয়ের নায়ককে নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছে। বলাবলি হচ্ছে, মহম্মদ শামি, যশপ্রীত বুমরা, মহম্মদ সিরাজদের পর ভারতীয় ক্রিকেট পেয়ে গেল পেস বোলিংয়ের আরও এক কোহিনূর। ময়ঙ্কের বোলিংয়ের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। তাঁর নতুন নামকরণও হয়ে গিয়েছে। রাজধানী এক্সপ্রেস।

২০২১ সালে তারক সিনহার মৃত্যুর পর নয়াদিল্লির সনেট ক্লাবের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন তাঁরই ছাত্র তথা দিল্লির প্রাক্তন ক্রিকেটার দেবেন্দ্র। ময়ঙ্কের উত্থানও তাঁর হাত ধরেই। প্রথম দর্শনে কেমন লেগেছিল ময়ঙ্ককে? নয়াদিল্লি থেকে ফোনে এবিপি লাইভ বাংলাকে দিল্লির প্রাক্তন উইকেটকিপার দেবেন্দ্র বলছিলেন, ‘ছ-সাত বছর আগে বাবার হাত ধরে সনেট ক্লাবের ট্রায়ালে এসেছিল ময়ঙ্ক। ভীষণ রোগা, দেখলে দুর্বল মনে হতো। তবে এত জোরে বল করে যে, অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ওর স্পাইকড জুতো ছিল না। ওকে স্পাইক দেওয়া জুতো কিনে দিই আমরা।’ যোগ করলেন, ‘প্রথমে অনূর্ধ্ব ১৬ বিভাগে, তারপর অনূর্ধ্ব ১৯ বিভাগে – ধীরে ধীরে বিভিন্ন বয়সভিত্তিক ক্রিকেট খেলতে শুরু করে। সেই থেকে সফর শুরু হয় ওর। দিল্লি ও ডিস্ট্রিক্ট ক্রিকেট সংস্থার প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগে ও সনেট ক্লাবকে চ্যাম্পিয়ন করেছিল।’

ভারতীয় ক্রিকেট সম্প্রতি উমরন মালিককে দেখেছে। প্রবল গতিতে বল করেন। জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছিলেন। তবে এলোমেলো বল করেন বলে সেভাবে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারেননি। বরং, ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছেন। ময়ঙ্ক অবশ্য প্রথম ম্যাচেই গতির আগুনের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন অভ্রান্ত লাইন-লেংথের বিষ। যা দেখে মুগ্ধ সকলে।

কীভাবে এত অভ্রান্ত নিশানায় এত জোরে বল করছেন ময়ঙ্ক? দেবেন্দ্র বলছেন, ‘সনেট ক্লাবে শুরু থেকে আমাদের একটাই লক্ষ্য ছিল। এত জোরে বল করে ময়ঙ্ক, লাইন-লেংথ যেন ঠিক থাকে। এলোমেলো বোলিং যেন না করে। তাই ওকে অ্যাজিটাস বল দিয়ে বোলিং শুরু করাই। অ্যাজিটাস বিশেষ এক ধরনের বল। যা আরও শক্ত, ভারি। তা দিয়ে বল করলে লাইন-লেংথ নিখুঁত হয়। ওকে অ্যাজিটাস বলে বোলিং করানো শুরু করেছিলাম। ও তাতেও জোরে বল করছিল। তবে তাতে লাইন-লেংথের উন্নতি হয়েছিল।’ যোগ করলেন, ‘উমরন মালিক জম্মু ও কাশ্মীরের ক্রিকেটার। ওখানে ক্রিকেট কম হয়। দিল্লিতে প্রচুর ক্রিকেট খেলা হয়। বেশি ক্রিকেট খেললেই লাইন-লেংথ শুধরে যায়। ময়ঙ্কেরও তাই হয়েছে। সুন্দর অ্যাকশন। আমরা অ্যাকশন বদলানোর চেষ্টা করিনি।’

পাঞ্জাব কিংসের ম্যাচে ইংল্যান্ডের জনি বেয়ারস্টোকেও গতিতে পরাস্ত করে আউট করেছেন ময়ঙ্ক। ওই ডেলিভারিটা নিয়ে দেবেন্দ্র বলছেন, ‘পরিকল্পনামাফিক বল করেছে ময়ঙ্ক। এমনি এমনি উইকেট পায়নি। জনি বেয়ারস্টো কাট ও পুল খুব ভাল মারে। জায়গা পেলেই ছক্কা মেরে দেবে। তাই ওকে বডিলাইনে বল করেছে। মারার জায়গা দেয়নি। তাতেই উইকেট পেয়েছে।’ দেবেন্দ্র আরও বললেন, ‘ওর প্রথম ম্যাচ ছিল। আরও ম্যাচ খেলুক। আরও দুর্দান্ত সব অস্ত্র আছে ওর আস্তিনে। ভাল ইয়র্কার করে, স্লোয়ার দেয়। সেটা যত দিন যাবে দেখতে পাবেন।’

বয়স মাত্র ২১ বছর। তিন বছর আগে ঘরোয়া ওয়ান ডে ক্রিকেটে অভিষেক। প্রথম ম্যাচেই তিন উইকেট নিয়ে জেতান দিল্লিকে। ২০২২ সালে প্রথম রঞ্জি ট্রফি খেলেন ময়ঙ্ক। সে বছরই সৈয়দ মুস্তাক আলি টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক। দেবেন্দ্র বলছেন, ‘ভীষণ পরিশ্রমী ছেলে। শৃঙ্খলাপরায়ণ। শুনলে অবাক হবেন যে, ও নিরামিষাশী। আমিষ খায় না।’ কিন্তু কেন? ‘রাধাকৃষ্ণের ভক্ত ময়ঙ্ক। পুজো করে রোজ। তাই আমিষ খায় না,’ বলছিলেন দেবেন্দ্র।

শুনলে চমকে উঠতে হয়। একটা সময় বলা হতো, আমিষ খান বলে পাকিস্তানি পেসাররা এত জোরে বল করতে পারেন। সরফরাজ নওয়াজ, ইমরান খান, ওয়াসিম আক্রম, ওয়াকার ইউনিস, শোয়েব আখতার, উমর গুল, মহম্মদ আমির – কী সব দুর্দান্ত পেসার বিশ্ব ক্রিকেটকে উপহার দিয়েছে পাকিস্তান। সেখানে নিরামিষাশী হয়েও এত জোরে বল করেন কী করে ময়ঙ্ক? দেবেন্দ্র বলছেন, ‘গতি ওর সহজাত। ওর বলের গতি ঈশ্বরপ্রদত্ত। দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবে না যে, এই ছেলে এত জোরে বল করে। প্রোটিন ডায়েট মেনে চলে। প্রচুর শাকসব্জি খায়। নিরামিষের মধ্যেও এমন অনেক খাবার আছে যা শরীরে জোর জোগায়। পেশিশক্তি বাড়ায়। বিরাট কোহলিকে দেখুন। ও ভেগান। অথচ ভারতের সবচেয়ে ফিট ক্রিকেটার।’

দিল্লির হয়ে টি-টোয়েন্টিতেও খুব ভাল খেলেছেন ময়ঙ্ক। ‘তিন বছর আগে একটা ম্যাচে শেষ ওভারে তিন রান দরকার ছিল আর সেটা ও করতে দেয়নি। বল হাতে দলকে ম্যাচ জেতায়। পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটেও ভাল খেলেছে। দলীপ ও দেওধর ট্রফিতেও দুর্দান্ত বল করেছিল। দেওধর ট্রফিতে ঘণ্টায় ১৫৫ কিলোমিটার গতিতে বল করেছিল,’ বলছিলেন দেবেন্দ্র। যোগ করলেন, ‘তবে দিল্লির হয়ে শেষ লিস্ট এ ম্যাচে ও হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পায়। রঞ্জি ট্রফিতে খেলতে পারেনি সেই জন্য।’

আইপিএলে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু কিছুতেই যেন আর একাদশের দরজা খুলছিল না। দেবেন্দ্র বলছেন, ‘গত দু’বছর ধরে মনে হচ্ছিল, এই বুঝি ওর আইপিএল অভিষেক হবে। তবে সুযোগ হচ্ছিল না। হতাশ হতো মাঝে মধ্যে। ওকে বোঝাতাম, পরিশ্রম করে যাও। নিশ্চয়ই সুযোগ পাবে। সুযোগ পেলে সেটা কাজে লাগাতে হবে। সুযোগ পেয়ে কী করল, সেটা তো সকলেই দেখেছেন।’ যোগ করলেন, ‘খুব ভদ্র ছেলে। সবাইকে শ্রদ্ধা করে। কোনওদিনও মুখের ওপর জবাব দেয় না। গত আইপিএলের পর জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী শিখলে? পরামর্শ দিয়েছিলাম, চোট না সারলে খেলো না। ও-ও সেটার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছিল। সম্পূর্ণ ফিট হয়ে ফিরল।’ ছোটবেলার কোচ আরও বললেন, ‘ময়ঙ্কের গাড়ি নেই। মেট্রোয় করে প্র্যাক্টিসে আসে। ওর ফেভারিট বোলার ডেল স্টেন। লখনউ সুপার জায়ান্টসে বোলিং কোচ হিসাবে মর্নি মর্কেলকে পেয়েছে। তাতেও উপকৃত হবে।’

নয়াদিল্লির পাঞ্জাবি বাগে থাকেন ময়ঙ্ক। বাবা, মা ও বোনকে নিয়ে সংসার। দেবেন্দ্রর কথায়, ‘পাঞ্জাব কিংসের বিরুদ্ধে ম্যাচের সেরা হয়েই ফোন করেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন লাগল স্যর? আমি বলি গোটা বিশ্ব তোমাকে দেখেছে। প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গেল।’

নয়াদিল্লির সনেট ক্লাব ছুঁয়ে রাজধানী এক্সপ্রেস ছুটতে শুরু করেছে…

আরও পড়ুন: রাহুল-আথিয়ার পরিবারে আসছে খুদে সদস্য? সুনীল শেট্টির মন্তব্যে জল্পনা তুঙ্গে

আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে