জনমুখী, শিল্প ও বিনিয়োগবান্ধব বাজেট চায় এফবিসিসিআই

বর্তমানে জাতীয় অর্থনীতি একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ালেও করোনা পরবর্তী দীর্ঘমেয়াদী বিরূপ প্রভাব এবং চলমান রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্য সংকটের মধ্যেও এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতির উন্নয়নের গতিধারাকে এগিয়ে নিতে হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সহায়ক পরিবেশকে আরও সুদৃঢ় ও জোরদার এবং চলমান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, দেশের বিনিয়োগ ও উৎপাদনশীল খাতকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে একটি শিল্প ও বিনিয়োগবান্ধব বাজেট চায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি- এফবিসিসিআই।

বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) বিকালে রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং এফবিসিসিআই’র যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পরামর্শক কমিটির ৪৪তম সভায় আগামী জাতীয় বাজেট প্রসঙ্গে এই প্রত্যাশার কথা জানান এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম।

এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দিক-নির্দেশনা, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ পরিকল্পনা এবং আন্তরিক প্রয়াস আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সুদৃঢ় করেছে। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। সেই সঙ্গে আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট উন্নত বাংলাদেশে উন্নীত হওয়ার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সরকার চতুর্থবারের মতো দায়িত্ব গ্রহণ করায় আগামী বাজেটকে ঘিরে জনগণের ব্যাপক প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে একটি জনমুখী ব্যবসা-বান্ধব বাজেট প্রণীত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন এফবিসিসিআই সভাপতি।

ব্যবসায়ীদের ওপর থেকে করের বোঝা কমানো, আমদানিকৃত কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যসহ শিল্প উপকরণের ওপর আরোপিত অগ্রিম আয়কর (এআইটি), আগাম কর (এটি) প্রভৃতি প্রত্যাহার, ব্যাংক ঋণের সুদহার হ্রাসসহ আমদানি পণ্যের যথাযথ শুল্কায়ন এবং পণ্য খালাসের জটিলতা দূর করতে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় অটোমেশন বাস্তবায়নের প্রস্তাব তুলে ধরেন মাহবুবুল আলম। পাশাপাশি কর হার কমিয়ে আয়কর ও মূসকের আওতা সম্প্রসারণ করে রাজস্ব আয় বাড়ানো, সক্ষম ব্যক্তিদের করের আওতায় আনার মাধ্যমে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি এবং রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে স্থানীয় বাজার থেকে সংগৃহীত পণ্য, কাঁচামাল ও সেবা ক্রয়কে ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখার আহ্বান জানান এফবিসিসিআই সভাপতি।

আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ও সুশাসন নিশ্চিতকরণে ব্যাংকিং কমিশন গঠন কিংবা ব্যাংক খাত সংস্কার কর্মসূচী গ্রহনের ওপর গুরুত্ব দেন মাহবুবুল আলম। সেইসঙ্গে মূল্যস্ফীতি এবং মানুষের প্রকৃত আয় বিবেচনায় রেখে আগামী জাতীয় বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা ৪ লাখ টাক থেকে বৃদ্ধি করে সাড়ে ৪ লাখ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব দেন তিনি।

মাহবুবুল আলম বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফিতি নিয়ন্ত্রণ ও বাজার মনিটরিং, বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্স প্রবাহ, রপ্তানি বৃদ্ধি, বহুমুখীকরণ, সম্প্রসারণ ও নতুন বাজার সংযোজন, মানব সম্পদ উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, সুদের হার এবং আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন কার্যক্রম জোরদারকরণ, ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও বৃদ্ধিকরণ, রাজস্ব নীতির সংস্কার এবং মুদ্রা ও রাজস্ব নীতির মধ্যে সমন্বয়, সর্বস্তরে সুশাসন এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাই জাতীয় অর্থনীতিতে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে।

এই অবস্থায় এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, অষ্টম পঞ্চমবার্ষিকী পরিকল্পনা, এসডিজি অর্জন, নির্বাচনি ইশতেহার, স্মার্ট বাংলাদেশ ও সর্বোপরি ভিশন ২০৪১-কে সামনে রেখে আমাদের অর্থনৈতিক পলিসি সমন্নয় করা জরুরী বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, বিদ্যমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহ বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় লক্ষ্যমাত্রাসমূহের আলোকে সুষ্ঠু অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সমুন্নত রাখতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় পর্যায়ক্রমে সুদৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করার লক্ষ্যে আগামী ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকবে বলে এফবিসিসিআই মনে করে।

বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানকে দৃঢ় করতে ব্যবসায়িক খরচ (কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস) কমিয়ে আনা, বিনিয়োগ সুরক্ষা, বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সুষম বিনিয়োগ সহায়ক মূদ্রা ও শুল্ক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, শিপিং খরচসহ সকল ধরণের পরিবহন খরচ হ্রাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানীসহ প্রভূতি ক্ষেত্রে স্থায়ী পরিকাঠামো উন্নয়নে স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করার পাশাপাশি কর আদায়ের ক্ষেত্রে হয়রানি ও জটিলতা দূরীকরণের মাধ্যমে ব্যবসা-বান্ধব কর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে আগামী বাজেটে বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়ার আহ্বান জানান মাহবুবুল আলম।

আগামী ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রণয়নে বেশ কিছু বিষয়ে আলোকপাত করেন এফবিসিসিআই সভাপতি। এরমধ্যে কর্মসংস্থানের স্বার্থে বিনিয়োগ, দেশীয় শিল্প ও সেবা এবং সিএমএসএমই-কে শুল্ক করের যৌক্তিক প্রতিরক্ষণ প্রদান, ক্ষেত্র বিশেষে অব্যাহতি বা বন্ড সুবিধা দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক ভিত্তিতে রপ্তানি বৈচিত্রকরণের  প্রয়াস অব্যাহত রাখা, ভোগ্য পণ্যসহ নিত্য ব্যবহার্য্য পণ্যের মূল্য ও সরবরাহ স্থিতিশীল রাখা, করনীতি, কর পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন, অটোমেশন ও ইন্টিগ্রেশনের মাধ্যমে নেট বা কর জাল সম্প্রসারণ করা, স্বেচ্ছায় কর প্রতিপালন হার বৃদ্ধিপূর্বক রাজস্ব আদায় তথা কর জিডিপি’র অনুপাত বৃদ্ধি করা, আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও যথাযথ করনীতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করা, সমন্বিত শুল্ক-কর এবং মুদ্রা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ।

সভায় ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরের বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে এফবিসিসিআই’র সুপারিশস তুলে ধরেন সভাপতি মাহবুবুল আলম। এরমধ্যে সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে ব্যাংকিং ও ফিন্যান্সিয়াল সেক্টরে শৃঙ্খলা ও সুশাসন নিশ্চিত, বিনিয়োগ বাড়াতে এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার লক্ষ্যে সুদের হার স্থিতিশীল রাখা ও বিনিয়োগের স্বার্থেই সুদের হার কমিয়ে আনা, বৈদেশিক অর্থায়নে এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর আওতায় প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং অপ্রয়োজনীয় ও অনুৎপাদনশীল প্রকল্প গ্রহণ থেকে বিরত থাকা, অর্থ পাচার/মানি লন্ডারিং রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত, রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি করার পদক্ষেপ গ্রহণ, সম্ভাবনাময় এবং নতুন জনশক্তি রফতানি বাজার সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া, ইকোনমিক ডিপ্লোমেসি তথা বাংলাদেশের বৈদেশিক মিশনগুলিকে দেশের রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখা এবং এক্ষেত্রে কমার্শিয়াল কাউন্সিলরদের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে জবাবদিহির আওতায় আনা, রাজস্ব বাড়াতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ জোরদারকরণ, রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগীতায় টিকে থাকতে নগদ সহায়তার বিকল্প সুবিধা নিশ্চিত করা এবং বিকল্প সহায়তা হিসেবে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও পরিবহন খাতে প্রণোদনা বা বিশেষ সুবিধা প্রদানের প্রস্তাব করা হয় এফবিসিসিআই এর পক্ষ থেকে।  

সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী জানান, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে বর্তমান সরকার বেসরকারি খাতকে সঙ্গে নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত প্রস্তাবনাগুলো আগামী জাতীয় বাজেটে সরকার গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবে বলেও এসময় জানান অর্থমন্ত্রী।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান জানান, প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়চিত্ত নেতৃত্বে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশের অর্থনীতি সামনের পথে এগিয়ে চলেছে।

সভায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। তিনি বলেন, আগামী জাতীয় বাজেটকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে খাতভিত্তিক ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সঙ্গে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং তাদের প্রস্তাবনাগুলো থেকে যৌক্তিক প্রস্তাবনাগুলো বাজেটে তুলে ধরতে কাজ করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ব্যবসায়ীদের মধ্যে কোনও অসন্তোষ থাকলে সেগুলো সমাধানে এনবিআর কাজ করবে বলেও জানান তিনি। উন্নত আধুনিক ও সুখী সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা চান তিনি।