Amar Sarkar Amar Dorkar: ‘দেশে চাই বাংলাপন্থী সরকার, বাঙালির জন্য সরকার, আমরা আর বঞ্চনা সহ্য করব না’

ভারতে লোকসভা নির্বাচন চলছে, লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনের মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। এটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাচনের ভোট। তাই দাবিগুলো সবই দিল্লির অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি হওয়া উচিত। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং বিভিন্ন দলের প্রচার দেখে মনে হবে যে বিধানসভা নির্বাচন হচ্ছে। যে সমস্ত বিষয় কেন্দ্র তালিকায় বা যুগ্ম তালিকায় সেইসব বিষয়ের উপরেই লোকসভা নির্বাচন। কেন্দ্র তালিকাভুক্ত বিষয় যেমন প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র, বিদেশ, জাহাজ, বন্দর, অর্থ, রেল ইত্যাদি। যুগ্ম তালিকাভুক্ত বিষয়গুলি হল- শিক্ষা, বনাঞ্চল ইত্যাদি। আইন-শৃঙ্খলা, কৃষি, সেচ এবং ভূমি-রাজস্বের মত বিষয়গুলো রাজ্য তালিকাভুক্ত। রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়গুলোতে আলোচনা হওয়া উচিত বিধানসভা ভোটের সময়। আমি মূলত লোকসভা ভোট যে সমস্ত বিষয় হওয়া উচিত এবং কেন্দ্র সরকারের কাছে যে সমস্ত দাবি করা যায় – সেই সমস্ত বিষয়ে আলোকপাত করছি।

স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলা রাজ্য এবং বাংলা ভাষা বঞ্চিত। স্বাধীনতার পর তৎকালীন কংগ্রেস সরকার থেকে শুরু করে বর্তমান বাঙালি-বিরোধী বিজেপি সরকার সকলেই বাঙালি জাতি এবং বাংলা রাজ্যকে ধ্বংস করতে উদ্যত। বাংলার খনিজ, বাংলার প্রাকৃতিক সম্পদ, বাংলার বন্দর সমস্ত কিছুর অধিকার থেকেই বঞ্চিত হয়েছে বাংলা। কেন্দ্রীয় বঞ্চনার শিকার এই বাংলা। বর্তমান সময়েও আমরা দেখতে পাচ্ছি যে বাংলায় ভোটে হেরে বাংলার প্রাপ্য টাকা দিল্লি অর্থাৎ বাঙালি-বিরোধী কেন্দ্রীয় সরকার কীভাবে আটকে রেখেছে। বাংলায় যাতে কোনও উন্নয়ন সম্ভব না হয়, নিশ্চিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে বিজেপি দল এবং তাদের কেন্দ্রীয় সরকার।

একটা কথা জনমানসে প্রচলিত আছে যে দিল্লি রাজ্যগুলোকে টাকা দেয়। কিন্তু এটা ভ্রান্ত। বাংলা-সহ বিভিন্ন রাজ্যগুলো থেকে যত ট্যাক্স তোলে, কেন্দ্রীয় সরকার তার একটা অংশ রাজ্যগুলোকে ফেরত দেয় দিল্লি। টাকা কম দিয়েও বেশি ফেরত পায় বিহার, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশের মতো গো-বলয়ের রাজ্যগুলো। তাই এ কথা সর্বৈব মিথ্যা যে দিল্লি বাংলাকে টাকা দেয়। বরং বাংলার টাকা তুলে অনুপাতে ফেরত না দিয়ে বাংলার সঙ্গে প্রবঞ্চনা করে দিল্লি।

ভারত ভাগ মানে আসলে বাংলা ভাগ বা পঞ্জাব ভাগ। বাংলার উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার খুবই লজ্জাজনক ভূমিকা পালন করেছিল। বর্তমান বিজেপি সরকার, হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী বিজেপি দল এবং বাঙালি-বিরোধী নেতারা আবারও সেই সমস্ত উদ্বাস্তু মানুষকে রাষ্ট্রহীন করার ঘৃণ্য পরিকল্পনা করেছে এবং নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে বাঙালিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। দেশভাগের বলি হওয়া মতুয়া, নমঃশূদ্র-সহ সমস্ত উদ্বাস্তু হিন্দু বাঙালিকে ঠকিয়ে তাদের ক্ষতি করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাচ্ছে বিজেপি দল।

বর্তমান যে লোকসভা নির্বাচনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচিত হবে, তা যে দলেরই হোক, তাদের কাছে বাংলার একজন বাঙালি হিসেবে অত্যন্ত সোচ্চার দাবি থাকবে যে কোনওভাবেই বাংলার প্রতি আর্থিক বঞ্চনা করা চলবে না। তিনি বিজেপির টিকিটে জিতুন, কংগ্রেসের টিকিটে জিতুন বা তৃণমূলের টিকিটে জিতুন- তিনি জিতছেন বাংলার মানুষের ভোটে। তাই বাংলার বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংসদে সরব হওয়া এবং বাংলার জন্য ন্যায্য দাবি আদায় করে নিয়ে আসাই হবে তাঁর কর্তব্য। তাই অত্যন্ত স্পষ্ট দাবি, বাংলার সমস্ত বকেয়া দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারকে বাংলার সরকারের হাতে দিতে হবে।

কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরির পরীক্ষাগুলো হিন্দি-ইংরেজিতে হয় অধিকাংশই, কিন্তু বাংলা ভাষায় দেওয়ার সুযোগ পায় না ছেলেমেয়েরা। কেন এই বঞ্চনা? তাই স্পষ্ট দাবি, সমস্ত কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির পরীক্ষা হিন্দি, ইংরেজির সঙ্গে বাংলা-সহ ২২টি সরকারি ভাষায় নিতে হবে।

পরাধীন ভারতকে স্বাধীন করতে বাঙালি সশস্ত্র আন্দোলন করেছিল, গড়ে তুলেছিল আজাদ হিন্দ ফৌজ। কিন্তু স্বাধীন ভারতে সেনাবাহিনীতে রাজপুত, গোর্খা, গাড়োয়াল, মাদ্রাজ ইত্যাদি রেজিমেন্ট থাকলেও বাঙালি রেজিমেন্ট নেই। একথা অত্যন্ত লজ্জার। এটা বীর সুভাষচন্দ্র বসুকে অপমান। ভারতীয় সেনায় বাঙালি রেজিমেন্ট তৈরি সময়ের দাবি।

উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির একাংশের (উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদা, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার) রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। বাসের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল মানুষ। হাওড়া বা শিয়ালদার ধাঁচে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনকে কেন্দ্র করে লোকাল ট্রেনের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। রায়গঞ্জে প্রস্তাবিত AIIMS নদিয়ার কল্যাণীতে তৈরি হওয়ায় উত্তরের জেলাগুলোর মানুষের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। বিহারে দুটো এবং উত্তরপ্রদেশে তিনটে AIIMS হলে বাংলায় একটা AIIMS নিয়ে উত্তর ও দক্ষিণে মারামারি হবে কেন? বাংলা থেকে বেশি ট্যাক্স দেয়। তাই নতুন যে দলেরই বা জোটেরই সরকার হোক রায়গঞ্জে বা জলপাইগুড়ির দোমোহনীতে দ্বিতীয় AIIMS চাই।

আগ্রার মতো কম উন্নত শহরেও মেট্রো রেল চালু হয়েছে। তাই বাংলার আসানসোল এবং শিলিগুড়িতে মেট্রো রেল চালু করতে হবে। দক্ষিণ দিনাজপুরের বুনিয়াদপুরে ২০১০-১১ সালে তৎকালীন রেলমন্ত্রী মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে রেল ওয়াগন ফ্যাক্টরি তৈরির ঘোষণা করেছিলেন এবং পরবর্তীতে বিজেপি সরকার যে রেল প্রকল্পটি বাতিল করেছিল, তা পুনরায় এবং অবিলম্বে শুরু করতে হবে। কলকাতা থেকে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, উত্তর এবং দক্ষিণ দিনাজপুর জলপাইগুড়ি কোচবিহার আলিপুরদুয়ারের দূরপাল্লার ট্রেনের সংখ্যা বাড়াতে হবে। করোনাকালে প্রচুর ট্রেন বা লোকাল ট্রেন বাতিল হয়েছিল, সেগুলো এখনও চালু হয়নি। অবিলম্বে চালু হওয়া প্রয়োজন।

মালদা ও মুর্শিদাবাদ জেলা নানা সময় গঙ্গা ভাঙনের ফলে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কিন্তু গঙ্গা ভাঙন রোধে কেন্দ্র সরকার বিশেষ ভূমিকা পালন করে না। গঙ্গা ভাঙন হোক বা আমফান হোক বা যে কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় কেন্দ্র সরকার বাংলাকে বঞ্চনা করে। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় যাতে দিল্লির কেন্দ্র সরকার বাংলাকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেয়, সেই ব্যবস্থা নির্বাচিত সাংসদদের বা সরকারকে করতে হবে।

সমস্ত কেন্দ্র সরকারি চাকরি কুক্ষিগত করছে হিন্দি বলয়। তাই সমস্ত কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরিতে রাজ্যের কোটা থাকতে হবে। পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের মাধ্যমে হিন্দি রাজ্যগুলিকে বেশি টাকা দেওয়া হচ্ছে। হিন্দি বলয়ে জনসংখ্যার বিস্ফোরণের কারণে ডিলিমিটেশনের ফলে হিন্দি রাজ্যগুলির সাংসদদের অনুপাত অনেক বেড়ে যাবে। অন্যদিকে বাংলা, তামিলনাড়ু, কেরল, পঞ্জাব, কর্ণাটক ইত্যাদি শিক্ষিত ও উন্নত রাজ্যের সাংসদদের অনুপাত অনেক কমে যাবে। অহিন্দি রাজ্যগুলো সংসদে সংখ্যালঘু বা ভয়েসলেস হয়ে যাবে। তাই যে দলেরই বা যে জোটেরই সরকার নির্বাচিত হোক, তাদের ডিলিমিটেশনের বিপক্ষে হাঁটতে হবে।

স্বাধীনতার পর থেকে কেন্দ্র সরকার বাংলায় কোনও কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেনি। বাঙালি আইকন তৈরি বিশ্বভারতীকে করেছিল কেন্দ্র এবং সেটিকে দায়িত্ব নিয়ে ধ্বংস করছে বর্তমান কেন্দ্র সরকার। বাংলায় একটি নতুন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং একটি উচ্চমানের গবেষণা কেন্দ্র প্রয়োজন।

এতগুলো নির্বাচন হয়ে গেছে। কিন্তু বাংলা রাজ্য, বাঙালি জাতি বা বাংলা ভাষা কোনও অধিকার পায়নি। গত পাঁচ-ছয় বছরে বাঙালি জাতির জনজাগরণ হচ্ছে, তাই এইবারের ভোটে বা নতুন নির্বাচিত সরকারের থেকে নিজেদের প্রাপ্য আদায় করে নেবে বাংলার সাংসদরা ও বাঙালি জাতি। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো অত্যন্ত শক্তিশালী হবে। ভারতের সংস্কৃতি বহুত্ববাদী সংস্কৃতি।

‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান/বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান’

শুধুমাত্র একটা ভাষা মানে হিন্দি ভাষা আমাদের বাংলাকে গ্রাস করে নেবে না, বাঙালির ধর্মাচরণ এবং বাঙালির খাদ্যাভ্যাস আক্রান্ত হবে না, সেই মর্মে দলমত-ধর্ম নির্বিশেষে সাংসদরা কাজ করবেন এবং নতুন সরকার বাংলার ক্ষতি না করে বাংলা রাজ্যের স্বার্থে বিভিন্ন দাবি পূরণ করবে এই আশা রেখে এই লেখা শেষ করছি।

(লেখক কৌশিক মাইতি বাংলা পক্ষের শীর্ষ পরিষদ সদস্য ও সাংগঠনিক সম্পাদক। লেখকের মতামত একান্ত ব্যক্তিগত, তা হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার মতামত নয়)।