ক্যাম্পকে ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ ভেবে বড় হচ্ছে যে শিশুরা

নাফ নদীর ওপারে যুদ্ধ চলছে। হামলার শব্দ, আগুন থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া এপারে ভেসে আসে। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে সাত বছর আগে মায়ের কোলে করে বাংলাদেশে চলে আসা শিশুরা বড় হচ্ছে বাংলাদেশের কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। ২০১৭ সালে ‘ফেলে আসা জীবন’ নিয়ে বাবা-মায়ের মুখে সেই ভয়াবহতার গল্প শুনে শুনে বড় হওয়া এই শিশুরা মনে করে, তারা সেই যুদ্ধের মধ্যেই আছে। ক্যাম্পের জীবনও তাদের জন্য একটা ‘যুদ্ধক্ষেত্র’। শরণার্থী অভিবাসন নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা বলছেন— ক্যাম্প হয়তো জীবনের নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু ক্যাম্পই তো আসলে ‘জীবন’ নয়। এখানে অনিশ্চয়তা নিয়েই প্রতিনয়ত যুদ্ধ করেই বাঁচতে হয়। আর শিশু অধিকারকর্মীরা বলছেন, যেসব শিশু শৈশবেই অনিশ্চয়তার মানে বুঝে যায়, তাদের যে পরিমাণ মানসিক সহায়তা দরকার; তার কতটুকুই বা ক্যাম্প দিতে পারে!

উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাদের বয়স এখন ১১ থেকে ১৬ বছর। তারা সাত বছর আগে যখন এসেছে। তখনও তাদের কেউই বুঝতো না মায়ের কোলে চড়ে, বাবার ঘাড়ে উঠে দৌড়ে কোথায় যাচ্ছে। যাদের বয়স ছিল ৪ বছর থেকে ৯ বছর। তারা একটু একটু করে বড় হচ্ছে। তারাও বুঝতে শুরুর পর থেকে ‘ক্যাম্প-জীবনকে’ দেখছে। সেখানে ১০ ফুট বাই ১০ ফুটের ঘরেই তাদের জীবন।

বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার যৌথ ফ্যাক্ট শিটের জানুয়ারির হিসাব বলছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বর্তমান জনসংখ্যা ৯ লাখ ৭৫ হাজার ৩৫০। এরমধ্যে ৫২ শতাংশই শিশু। সেই শিশুদের মধ্যে ৫ বছর থেকে ১১ বছরের ২১ শতাংশ, আর ১২ বছর থেকে ১৭ বছরের ১৫ শতাংশ শিশুর উল্লেখ আছে। ক্যাম্প ১, ৭ ও ৯-এর একটি করে ছেলেশিশু ও একটি করে মেয়েশিশুর মোট ছয়টি দলের সঙ্গে ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশনের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে তাদের ভাবনার কথা।

‘রূপকথার মতো শুনি সব আছে’

২ মে ২০২৪, উখিয়া, ক্যাম্প-৭ এ ছয়টি ছেলে শিশুর একটি দলের সঙ্গে কথা হয়। ১১ বছর বয়সী এক শিশু চার বছর বয়সে থাকতে এ দেশে এসেছে কোলে চড়ে। এরপর সে জেনেছে, যেখানে সে থাকে সেটা তার নিজের জায়গা না। ওই দূর পাহাড়ে তাদের দেশ। তবে সেখানে যাওয়ার সুযোগ নেই। কোনো একদিন হয়তো ফিরতে পারবে, কিন্তু কোথায় ফিরবে?

‘ওখানে গেলে তারা কেমন থাকবে’, বাবা-মা সেসব আলোচনা করে কিনা প্রশ্নে আরেক শিশু জোয়ায়ের বলে, মায়ের মুখে গল্প শুনেছে সে। সেখানে নিজেদের তিন কক্ষের একটি বাড়ি আছে, চাষের জমি আছে, অন্য আত্মীয়রাও কেউ কেউ আছে। 

এখনও আসলে এসব ঠিকঠাক আছে কিনা— কী মনে হয়, জানতে চাইলে ৫ সদস্যের মেয়েদের গ্রুপের একজনের উত্তর— ‘আছে মনে হয়’।

ঘরে বড়রা না থাকলে নিরাপত্তার জন্য বাইরের দরজায় বসিয়ে রাখা হয় শিশুদের। এতে অন্যরা তাদের দেখে রাখতে পারে।

‘খাবার অন্যে যেটুকু দেয় তাই খাই’

ক্যাম্প-৯ এর ছেলেদের দলকেও একই প্রশ্ন করা হয়। তাদের সবার বয়স ১০ থেকে ১৪। ‘কেমন কাটে ক্যাম্পে?’ প্রশ্নের জবাবে এদের মধ্যে সবচেয়ে বড়জন ১৪ বছর বয়সী কবির বলে, ‘আমরা ছোট থেকে সবচেয়ে বেশি শুনেছি যুদ্ধের কথা। আমাদের আসল বাড়ি যেখানে, সেখানে যুদ্ধ চলছে। তাই আমরা এখানে আছি। কিন্তু ক্যাম্পজীবনও তো যুদ্ধই। খাওয়ার ব্যবস্থা, থাকার ব্যবস্থা অন্য কেউ করে দেয়। হিসাব করে খাবার দেয়, খাবার কমিয়ে কমিয়ে দেয়। পানি এক জায়গায় গিয়ে লাইন ধরে জোগাড় করতে হয়— এসব যুদ্ধই। কেন আমরা এখানে সেই উত্তরও আমাদের কাছে নেই।

কবিরের বলা যুদ্ধের বিষয়ে একমত কিনা— জানতে চাইলে এই ক্যাম্পের মেয়েদের দলের ১১ বছরের এক সদস্য বলেন, ‘এখানেও আমাদের ভয়ে দিন কাটে। ইচ্ছেমতো চলার স্বাধীনতা নেই। সবাই কমবেশি চেনা, কিন্তু অচেনা মানুষও অনেক। আমাদের কেউ বিশ্বাস করে না। আমার অনেক বন্ধুর বিয়ে হয়ে গেছে। কতজনকে ক্যাম্প থেকে লুকিয়ে অন্যখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব বলতেও মানা।‘

ক্যাম্প-১ এর ছেলেদের দল রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে এই বয়সেই। ১১ থেকে ১৪ বছরের সাত শিশুর তিন জনই ফিরে যাওয়ার আন্দোলনের মিছিল-মিটিংয়ে নিয়মিত। মিয়ানমারে এখনও যুদ্ধ চলছে, তাহলে তারা ফিরতে চান কেন— প্রশ্নে তাদের একজন বলছেন, ‘আমরা এখান থেকে বের না হলে আমাদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। এখানে কেউ মারবে না আমাদের, কিন্তু বসে বসে যেটুকু সাহায্য পাবো, সারাজীবন সেটাই খাবো? নিজের জায়গায় যুদ্ধ করে হলেও সেখানেই থাকতে চাই।’

সাত নম্বর ক্যাম্পে ফুটবল দল আছে। তারা ফরমাল পোশাকে খেলাধুলা করে। ভবিষ্যতে বাইরে খেলতে সুযোগ পাবে, সে ভরসা তাদের নেই।

ফেরার বিষয়ে মা-বাবা কী বলেন, প্রশ্নে এখানকার মেয়েদের দলটির সবচেয়ে বড়জন ১৩ বছরের হেরাজান বলেন, ‘এখানে কেউ ঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে না বলে যুদ্ধ নাই, তা তো না। আমাদের জীবনটাই যুদ্ধের। সাত বছর হয়ে গেছে, এখন চলে যাবো নিজের জায়গায়। মা বলে— এখানে বন্দি জীবনে রোজ যুদ্ধ। এই কেউ মারা যাচ্ছে, এই পুলিশ অভিযান করছে, এই আগুন লেগে যাচ্ছে, মিছিল মিটিং করলেও ভয়ে ভয়ে করতে হয়।’

শিশু অধিকারকর্মী গওহার নঈম ওয়ারা মনে করেন, এই শিশুদের প্রতি নানাবিধ অন্যায় করা হচ্ছে। যেহেতু তারা শরণার্থী নয়, ফলে নানাবিধ অধিকারের দাবিদার নয়। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মনোসামাজিক অবস্থান নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই বন্দিজীবন, এই অপরাধপ্রবণ পরিবেশ তাদের প্রাপ্য না। তাদের যদি ট্রাভেল ডকুমেন্ট করে দেওয়া যায় তাহলে যে অবৈধ অর্থ লেনদেনের অভিযোগ ওঠে, সেখান থেকে তারা রক্ষা পায়। শিশুদের জন্য সর্বোচ্চটা করতে চাওয়া এবং পারা আমাদের উচিত। যেহেতু এখনই তাদের পাঠিয়ে দিতে পারছি না, সেহেতু ভাষাগত দূরত্ব যেন না থাকে, সেসব নিয়েও আমাদের পরিকল্পনা দরকার। 

গোসল থেকে শুরু করে পানি সংগ্রহ সবকিছুতে লাইন দেওয়া, উচুঁনিচু পথে গিয়ে খাবার সংগ্রহ এসব তাদের যুদ্ধই মনে হয়। একটু সুবিধা বঞ্চিত যেন না হতে হয়, তা নিয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব দেখে বড় হচ্ছে শিশুরা।

মা-বাবা তাদের কী বলেন— জানতে চাইলে ১৪ বছরের রিমা বলে, ‘‘আমাদের দেশ ‘বার্মা’, আমরা এখানে বিদেশি সাহায্য নিয়ে থাকি। ওই দিকের যুদ্ধ থামলে আমরা চলে যাবো।’’ 

এরই মধ্যে রিমার বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করেছে। এখানেই বিয়ে-সংসার ও আরও কতবছর থাকতে হবে ধারণা করতে পারেন কিনা প্রশ্নে সে বলে, ‘আমাদের দেশে যুদ্ধ শুরু হলো, কী রক্ত মারামারির মধ্যে পালিয়ে এলো সবাই, তাতে প্রাণ বেঁচেছে ঠিকই, কিন্তু যুদ্ধের মধ্যেই আছি। নিজের মাটিতে থাকলে ভরসা থাকে, আমাদের আসলে কোনও জীবন নেই।

‘ক্যাম্প-জীবন তো স্বাভাবিক জীবন হওয়ার কোনও সুযোগ নেই’ উল্লেখ করে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার শামসুদ্দৌজা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করি তাদের নানাবিধ অ্যাক্টিভিটির মধ্যে রাখতে। ফুটবল খেলার আয়োজন করা হয় কমিশনের পক্ষ থেকে। তারপরেও ক্যাম্প তো ক্যাম্পই। তাদের ফিরে যাওয়া নিয়ে নানা রাজনীতি আছে, সেসব কথা শিশুদের কানে যায়। তারা মানসিকভাবে বিভ্রান্ত বোধ করতে পারে।’