যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সাংকেতিক চিঠি

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ইস্যুতে চিঠি চালাচালি করতো। বিশ্বস্ত মানুষের হাতে করে সেই চিঠি গন্তব্যে পাঠানো হলেও বাহনকারীও জানতেন না যে, ভেতরে কী বার্তা লেখা আছে। এমনকি পথে যদি চিঠির বাহক শত্রুপক্ষের হাতে ধরা পড়ে, সেই শঙ্কায় চিঠি লেখা হতো সাংকেতিক ভাষায়। কেবল চিঠিটি জায়গা মতো গেলে প্রাপকই বুঝতে পারবেন— চিঠিতে কী বলা আছে। এর অনেকগুলো নমুনা পাওয়া যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের একাদশ খণ্ডে।

১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বরের একটি সাংকেতিক চিঠিতে লেখা হয়— ‘আশা করি, খোদার কৃপায় ভালো আছেন। আমাদের থানা ক্লাবের শাখা করেছি। আপনার কাছে কয়েকদিন পূর্বে পত্র লিখেছি। কিন্তু কোনও উত্তর পাইনি। আপনি যাওয়ার পর মৌলভী সাহেব আপনার সিটে থাকেন। তিনি কাচারি ঘরে আমাদের এলাকার বোনদেরকে কোরআন শরিফ পড়াচ্ছেন। মৌলভী সাহেব আপনার কথাটাই জিজ্ঞাসা করেন। তার কাছে পত্র লিখবেন। মিতা আমাদের এখানে আছে। দাদা গরুর খোয়াড় রেখেছেন। মামা ভালোই আছেন। বোনও ভালো। চিন্তা করবেন না। বাড়ির সবাই আল্লাহর কৃপায় ভালোই আছেন। কোনও প্রকার চিন্তা করবেন না। সবার কাছে শ্রেণী মতো দোয়া ও সালাম দেবেন। -ইতি, ছোট ভাই।’

একই হাতের আরেকটি চিঠি পাওয়া যায়, যেখানে বলেন যে, ‘অনেকদিন গত হতে চললো আপনার কোনও সংবাদ না পেয়ে চিন্তাযুক্ত আছি। কাকা পেপার মিলে বাঁশ দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন। এখন তার বাঁশ পাঠাতে হবে। তিনি কিছু টাকা তুলেছেন। ভাইজান খোকন বর্তমানে ২০টি কবুতর ক্রয় করতে চায়। তার জন্য একটি ঘুঘু পাঠাবেন। বড় ভাই সাহেবের বিয়ে ঠিক হয়েছে। আগামী ২৫ তারিখ বউ আনতে যাবেন। কাজেই অনেক টাকা পয়সার প্রয়োজন। আব্বার কাছে কোনও টাকা নেই। আর এখানে জিনিসপত্রের মূল্য অনেক বেশি। আপনি অতিসত্ত্বর একশ সতেরটি মুরগি পাঠাবেন, বড় মুরগি ১২টি, রোস্ট করার জন্য ৮০টি মুরগির ব্যবস্থা করবেন। জামাই নিয়ে যাওয়ার জন্য চারটি বড় নৌকা ব্যবস্থা করবেন। উত্তরপাড়ার ভাই সাহেব আপনার কাছে যে টাকা পাঠিয়েছেন, তা দিয়ে ৫ হাজার ডিম পাঠাবার জন্য বলেছেন। কারণ, তিনি ডিমের ব্যবসা করেন। কয়েকটা বড় হোটেলে তিনি ডিম পাঠান। এক হাজার লেবু পাঠানোর কথাও বলেছেন। এইগুলো না পাঠালে তার ব্যবসা বিরাট ক্ষতি হবে। আপনি এই সমস্ত জিনিসের ব্যবস্থা করে যেভাবেই হোক, বিয়েতে উপস্থিত হবেন। নয়তো দুঃখিত হবো।’

চিঠির উত্তরও পাওয়া যায় ১১ নম্বর সেক্টরের দলিল থেকেই। সেই চিঠিতে লেখা হয়, ‘প্রিয় ছোট ভাই, আমার স্নেহ নিও। তোমার চিঠি পেয়ে বেশ উদ্বিগ্ন হলাম। তোমার যে তিন বোনের কথা বলেছো ওদের নাম পাঠাও। বিশ্বাসঘাতকের একমাত্র শাস্তি মৃত্যু। ডাক্তার এবং সিরাজ সম্পর্কে আমাদের এই অভিমত। তবে যদি সম্ভব হয় ওদের যেভাবে পারো আমাদের কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা করো। না পারলে সিদ্ধান্ত তোমরাই নেবে। আগে যে নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছি, তা ঠিকমতো পালন করছো না। সব নির্দেশ ভালো রকম বুঝে পালন করতে চেষ্টা করবে। তোমাদের জন্য ডিম এবং মুরগি সত্ত্বর পাঠাবার ব্যবস্থা করবো। কিছু সময় লাগবে। যেসব ব্যাপার জানতে চেয়েছি, তা সত্ত্বর জানাবে। তোমার সাংসারিক খরচের জন্য একশ’ টাকা পাঠালাম। আহারের সংস্থান অবশ্যই স্থানীয়ভাবে করতে হবে। নকলার বড় বোন দুজনকে যোগাযোগ করতে বলো। ওরা নীরব কেন? আমরা ভালো আছি। তোমাদের কুশল কামনা করি। -ইতি বড় ভাই।’

২০ অক্টোবর ১৯৭১-এ যুদ্ধ পরিস্থিতি সংক্রান্ত জনৈক মুক্তিযোদ্ধার একটি চিঠি মেলে। সেখানে তিনি লিখছেন, ‘সবিনয়ে নিবেদন এই, আমরা ১৪ সেপ্টেম্বর ভালুকায় পৌঁছেছি। পথে পাক ফৌজের গ্রামের মধ্যে পড়ি। ৫-৬ ঘণ্টা ফাইট হয়। ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়, ১৭ জন পাক সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। আমি অনেক আগে সংবাদ দেবার চেষ্টা করেছি। শওকত আলীকে পাঠিয়েছিলাম। সে পথের মধ্যে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়লে, তাকে কৌশলে মুক্ত করা হয়েছে। আমি আকসার উদ্দিন সাহেবের সঙ্গে থেকে মুক্তিযুদ্ধে ডাক্তার হিসেবে কাজ করছি। আমাদের এখানে ১৮০/১৯০ মাইল পর্যন্ত মুক্ত এলাকা। আমি এসে অনেক ছেলে পাঠালাম। দেশে গিয়ে দেশের খুব শোচনীয় অবস্থা দেখেছি। আমরা ওই সময় দেশে পৌঁছাতে না পারলে বহু লোক রাজাকার হয়ে যেতো। আমাদের ভালুকার মুক্তিযোদ্ধারা অনেকে অস্ত্র ফেলে আত্মগোপন করেছিল। আমার ঘরবাড়ি বলতে কিছু নেই। পাক সেনারা পুড়িয়ে ফেলেছে।’

১১ নম্বর সেক্টরের দলিলেই পাওয়া যায় কোনও একজন মেজরকে লেখা একটি চিঠি— ‘মেজর সাহেব, আমার সালাম নেবেন। পর সমাচার এই যে, ২৭ অক্টোবর বিকাল তিন ঘটিকার সময় একটা পার্টি নিয়ে পেট্রোলে যাই এবং ফরেস্ট অফিসের সামনে বড় উঁচু একটা পাহাড়ে উঠে— অনেক নতুন ও পুরনো বাংকার দেখতে পেলাম। ফেরারি এলাকায় একটা পাহাড়ে তাদের ওপি পোস্ট তৈরি করছে এবং টেলিফোনের তার লাগিয়ে মাটির সঙ্গে ফেলে তৈরি করেছে। ওরা সব ঠিক করে যাওয়ার পর আমরা ওই টেলিফোনের তার সন্ধ্যা ৭টায় ৩৩ গজ কেটে আনি এবং ওরা যখন জানতে পেলো যে, আমরা তাদের টেলিফোন লাইন কেটে দিয়েছি, তখন আমাদের ওপর ওরা ফায়ার দেয় এবং আমরাও ১৫০ গুলি রাউন্ড ফায়ার দিয়ে ফিরে আসি। খোদার ফজলে আমাদের কোনও ক্ষতি হয়নি। ওদের টেলিফোন লাইন নষ্ট করে ৩৩ গজ তার নিয়ে এসেছি এবং ওই তার আপনাদের এখানে পাঠালাম।-ইতি মোহাম্মদ আলী আলী, পানীহান্তা এম এফ ক্যাম্প।’

মুক্তিযোদ্ধা ও গণহত্যা বিষয়ক গবেষক ড. এম এ হাসানের কাছে এ ধরনের চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যোগাযোগ তো এখনকার মতো সহজ ছিল না। তখন খুব সংক্ষেপে চিঠি লিখে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাঠানোর চল ছিল। যার হাত দিয়ে চিঠি পাঠানো হচ্ছে সে ধরা পড়লে, সেই চিঠির পাঠোদ্ধার যেন সম্ভব না হয়, সেজন্য স্থান কাল এসব উল্লেখ না করে সাংকেতিক ভাষায় কেবল ইনফরমেশনটা  পাঠানো হতো। এ রকম অনেক কিছু পরবর্তীতে পাওয়া গেছে।’