বিএনপি রূপরেখার নামে ষড়যন্ত্র আঁটছে কিনা, প্রশ্ন আ. লীগের

রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা ঘোষণার নামে বিএনপির দেশকে রসাতলে নেওয়ার ষড়যন্ত্র আঁটছে কিনা, সেই প্রশ্ন তুলেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশকে মেরামত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার আগে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সম্পর্কে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট করা উচিত বলেও মনে করে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। তারা বলেছেন, গণতন্ত্র হত্যাকারী ও দেশবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বিএনপি এখনও দেশের জনগণের কাছে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে পারেনি। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী না, পাকিস্তানি প্রেতাত্মা হিসেবে দেশের স্বাধীনতা বিনষ্ট করতে চায় তা অস্পষ্ট।

এদিকে ক্ষমতাসীন জোট সমর্থিত বাম নেতারা বলেছেন, অতীতে বিএনপি সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা উৎপাটন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রবর্তন করে রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কার করেছে। এবার ‘রেইনবো নেশন’-এর নামে জঙ্গি ও ইসলামি ফোর্স নিয়ে বাংলাদেশকে সংস্কার করবে।

সোমবার (১৯ ডিসেম্বর) রাজধানীর একটি ৫ তারকা হোটেলে ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা’ শিরোনামে ২৭ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছে বিএনপি। দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন এই রূপরেখা তুলে ধরেন।

বিএনপির রূপরেখার বলা হয়, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠা করা হইবে। এ জন্য অব্যাহত আলোচনা, মতবিনিময় ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎমুখী এক নতুন ধারার সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছাতে হবে।

এজন্য নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন, উচ্চকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন, সুপ্রিম জুডিসিয়াল কমিশন গঠন, ন্যায়পাল গঠন, অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন ইত্যাদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দলটি।

বিএনপির ২৭ দফা ঘোষণার পর এর সমালোচনা করে রাজধানীতে দলীয় এক কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘রাষ্ট্রকে যারা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে, তারা আবার এই রাষ্ট্র মেরামত করবে। মেরামত তো শেখ হাসিনা করেছেন। করেছেন বলেই তো আজকে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল।’

কাদের বলেন, ‘আজকে অনেকে রাষ্ট্র মেরামত করার প্রয়াস নিয়েছে। গতবারও ২৩ দল ছিল। এবার ৩৩ দল। বাম, ডান, এরমধ্যে প্রগতিশীল আর প্রতিক্রিয়াশীল একসঙ্গে হয়ে গেছে। সব এক কাতারে একাকার, লক্ষ্য কি শেখ হাসিনাকে হটানো!’

বিএনপির এর আগের ঘোষিত কর্মসূচির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘শুনেছিলাম, ডিজিটাল বাংলাদেশের কাউন্টার ভিশন-২০৩০, বিএনপির। সেটা কোথায়? এখন কর্মসূচি দিয়ে দেখাচ্ছে তারা আছে। তাদের নেতাকর্মীরা বহুদিন ক্ষমতায় নেই, তাতেই খায় খায় ভাব। তাদের একটু খুশি রাখতে হবে। সেই জন্য অনেক কথা বলছে।’

বিএনপির ঘোষিত কর্মসূচির বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম  বলেন, ‘তারা অনেক কিছু করবে বলেছে। ১০-১৫টি কমিশন করবে বলেছে। তারা এটা কি নির্বাচনি ম্যানুফেস্টো ঘোষণা করেছে না অন্যকিছু? নির্বাচনি ইশতেহার হলে তো ভালো। তারা তাদের প্রতিশ্রুতি নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে যাক। নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে বাস্তবায়ন করুক। আমরাও চাই, সেই বিশ্বাসের জায়গাটা তারা তৈরি করুক।’

তিনি বলেন, ‘দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ‍মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে ধ্বংসকারীরা রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের নামে দেশটাকে রসাতলে নিয়ে যাওয়ার কোনও দুরভিসন্ধি করছে কিনা, এমন প্রশ্ন রেখে নাছিম বলেন, ‘দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত যাদের দলের নেতারা, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদের সঙ্গে যাদের নিবিড় সম্পর্ক, গণতন্ত্র হত্যাকারী ও দেশবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বিএনপি দেশের জনগণের কাছে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে পারেনি। বাংলাদেশকে মেরামত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার আগে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সম্পর্কে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট করা উচিত। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে কিনা, নাকি পাকিস্তানি প্রেতাত্মা হিসেবে দেশের স্বাধীনতা বিনষ্ট করতে চায়, সেটাই তো মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হলে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে হবে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে তাদের সরকার গঠন করার কোনও সম্ভাবনা দেখছি না। বিএনপির আগামী নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের কোনও সম্ভাবনা নেই।’

বিএনপির প্রতিশ্রুতিগুলোকে উদ্ভট ও অসাংবিধানিক আখ্যায়িত করে আইনজীবী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আদালতের আদেশে বাতিল হওয়া অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার কথা তারা বলছেন। এটা সংবিধানে তো বলা আছে। এছাড়া তারা কি ওয়ান ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে তাদের কথিত নেতার অত্যাচারের শিকার হওয়ার বিষয়টি ভুলে গেছেন? তারা ভুলে গেলেও আমরা এটা ভুলে যাইনি।’

বিএনপির রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার জাতি আগেও দেখেছে বলে মন্তব্য করেছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেন, ‘সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা উৎপাটন করে, সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা বদল করে এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রবর্তন করে রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কার করেছে।’

‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণার প্রসঙ্গ টেনে মেনন খান বলেন, ‘রংধনুর সাত রঙের মধ্যে তারা কিছু লাল, কিছু কমলা টেনে ‘রেইনবো নেশন’-এর নামে জঙ্গি ও ইসলামি ফোর্স নিয়ে বাংলাদেশকে সংস্কার করবে।’

১৯৯১ সালে সংসদ সদস্য হিসেবে বিএনপির সংবিধান সংস্কার প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকার কথা জানিয়ে মেনন খান বলেন, ‘১৯৯১ সালের পরে আমি তাদের সংবিধান সংস্কার কমিটিতে ছিলাম। সেই সময় আমরা দেখেছি, ৭০ বিধিকে কীভাবে আরও শক্ত করা যায়, খালেদা জিয়ার পদকে শক্ত করা যায়, সেটাই ছিল তাদের লক্ষ্য। দিনের পর দিন  তাদের আলোচনায় এগুলো দেখেছি। কাজেই তাদের সংস্কারের অর্থ হলো অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ভিত্তি সংস্কার করতে চায়। তারা পররাষ্ট্রনীতি সংস্কার করে আমেরিকান ব্লকে আমাদের নিয়ে যেতে চায়।’

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার বলেন, ‘তারা এক দফা, ১০ দফা, ২৭ দফা, এরপর হয়ে তো ৩৩ দফা বা যতই দফা দিক না কেন, তার কোনোটিই কাজে আসবে না, যদি না তারা সাংবিধানিক ধারায় নিয়মমাফিক নির্বাচন প্রশ্নে একমত না হয়। সাংবিধানিক ধারা অক্ষুণ্ন রেখে একটি নিয়মমাফিক দেশ চলছে। কাজেই তাদের কোনও দফাই কাজে আসবে না, যদি না তারা সাংবিধানিক ধারায় ফিরে না আসে।’