মনোজ-অনুষ্টুপের লড়াইয়ের পরেও উনাদকাটদের রঞ্জি হাতে তোলা সময়ের অপেক্ষা

সব্যসাচী বাগচী 

২২ বছর আগে ইডেন গার্ডেন্সের সেই ঐতিহাসিক টেস্ট ম্যাচ কি ফিরে আসবে! ভিভিএস লক্ষ্মণ ও রাহুল দ্রাবিড়ের সেই মহাকাব্যিক লড়াইয়ের রিমেক কি ফের দেখা যাবে! ২০০১ সালে স্টিভ ওয়া-র অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সৌরভ গঙ্গোপাধায়ের ভারতীয় দলের তো এমনই পরস্থিতি হয়েছিল। একেবারে দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছিল পিঠ। ফলো-অন করতে নামা ‘মেন ইন ব্লু’ ব্রিগেডের দুই যোদ্ধা সেদিন খেলা ঘুরিয়ে দেন। ঠিক ২২ বছর পর যেন অনেকটা একই রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। রঞ্জি ট্রফির ফাইনালে দল যখন প্রায় কোমায় চলে গিয়েছে, ঠিক সেই সময় বাংলার দুই অভিজ্ঞ মনোজ তিওয়ারি ও অনুষ্টুপ মজুমদার বাইশ গজে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন! তবে পারলেন না। আর তাই তো অনুষ্টুপকে ফিরিয়েই অত্যন্ত হিংস্র মেজাজে দুই হাত তুলে চিৎকার করলেন জয়দেব উনাদকাট। তাঁর টার্গেট ছিল ইডেনের লোয়ার ও আপার টায়ার ভর্তি গ্যলারি ও লক্ষ্মী রতন শুক্লার বঙ্গশিবির। যা শুধু দর্শকের মতো দেখা ও হা হুতাশ করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। 

কিন্তু চাপের এমন ডেসিবেল বেড়ে যাওয়ার তো দরকার ছিল না। প্রথম ইনিংসে ব্যাটিংটা পুরো ঘেঁটে যাওয়ার পর, বিপক্ষকে অল আউট করলেও ‘ভারতসেরা’ পেস বোলিং লাইন আপের মধ্যে আগুনে মেজাজ কোথায়! আসল পরীক্ষার মঞ্চে ডাহা ফেল বঙ্গ পেস অ্যাটাক। ঘরের মাঠের পিচে ভিনরাজ্যের জয়দেব উনাদকাট-চেতন সাকারিয়া পুরো ফায়দা নিলেন। তবে পারলেন না আকাশ দীপ, মুকেশ কুমার ও ঈশান পোড়েল। ফলে দেখতে দেখতে প্রথম ইনিংসে ৪০৪ রান তুলে দেয় সৌরাষ্ট্র। 

যদিও শনিবার দিনের শুরুটা বাংলার বোলাররা খারাপ করেননি। দিনের প্রথম ওভার বল করতে এসেছিলেন মুকেশ। এবং সেই ওভারের পঞ্চম বলেই বিপক্ষকে ধাক্কা দেন তিনি। ফিরিয়ে দেন সৌরাষ্ট্রের সেরা ব্যাটার অর্পিত ভাসাবাদাকে। যিনি দু’বছর আগেও রঞ্জির ফাইনালে বাংলার বিরুদ্ধে শতরান করেছিলেন। এবং এবারও ৮১ রান করে অপরাজিত ছিলেন। এদিন সকালে অবশ্য আগের দিনের স্কোরেই ফিরে যান অর্পিত। স্কোরবোর্ডে তখন আগের দিনের রানের সঙ্গে মাত্র এক রান যোগ হয়েছিল। বাংলার ক্রিকেটপ্রেমীরা আশা করেছিলেন, অলৌকিক কিছু সম্ভব।

কিন্তু অন্যরকম ভেবেছিলেন সৌরাষ্ট্রের টেলএন্ডাররা। প্রেরক মানকড় ৩৩, ধর্মেন্দ্র সিং জাদেজা ২৯ রান করেন। ১৪ রানে অপরাজিত ছিলেন পার্থ ভুট। চিরাগ জানি ৬০ রান করে ফেরেন। মুকেশ ১১১ রানে ৪, আকাশ ১১১ রানে ৩ উইকেট নিলেও, দুজনকে দেখে একবারও মনে হয়নি যে বিপক্ষ তাঁদের ভয় পেয়েছিলেন! 

আরও পড়ুন: Ben Stokes, NZ vs ENG: কোচ ম্যাকালামকে অবাক করে কোন রেকর্ড গড়লেন বেন স্টোকস? জানতে পড়ুন

আরও পড়ুন: Ravindra Jadeja as Pathaan: জাদেজাকে পাঠান নামে ডাকলেন বিরাট, ভিডিয়ো হল ভাইরাল

ঈশান পোড়েল পেলেন ৮৬ রানে ৩ উইকেট। তবে এবারও প্রভাব ফেলতে একেবারে ব্যর্থ। একেবারে প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ। মাত্র ছয় বছরের প্রথম শ্রেণির কেরিয়ারে দু’বার রঞ্জি ফাইনাল খেলার সুযোগ পেলেন ঈশান। কিন্তু গত ফাইনালের মতো এবারও এমন একটা মর্যাদা রক্ষার ম্যাচে দল ও জার্সির সম্মান রাখতে পারলেন না। এমন একটা ম্যাচে লড়াই করতে না পারে, আর কবে লড়বেন ঈশান! লাইন লেন্থের ঠিক নেই। একেবারে নেগেটিভ অ্যাপ্রোচ। বাংলার রঞ্জি ফাইনালের ইতিহাসে ঈশান যেন সবচেয়ে জঘন্য বল করার নজির গড়ে গেলেন। তাঁর বোলিং ফিগার ২১-৩-৮৬-৩, ইকনমি ৪.০৯। বোলিংয়ের সঙ্গে নিম্ন মানের ফিল্ডিং করে গেলেন ঈশান। বঙ্গ পেসার এমন বল গলিয়েছেন যে, অধিনায়ক মনোজও তাঁকে কোথায় রাখবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্যাচ ফেললেন অভিমন্যু ও সুমন্ত। 

২৩০ রানে এগিয়ে ছিল সৌরাষ্ট্র। ভঙ্গুর মানসিকতার দুই ওপেনারকে নিয়ে এমনিতেই কোনও আশা ছিল না। অভিমন্যু ঈশ্বরণ ফের প্রমাণ করে দিলেন যে তিনি নক আউট ম্যাচ এবং বিশেষ করে দ্বিতীয় ইনিংসে একেবারে ‘অচল আধুলি’। ঈশানের পর অভিমন্যু, অনেক বছর ধরেই এত সম্ভাবনাময়  তিনি। দেরহাদুনে ছেলের নামে স্টেডিয়াম তৈরি করেছেন। কিন্তু পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট গবেষণাগারও  একটা বৈশিষ্ট  তৈরি করতে অসমর্থ—বুকের খাঁচা। ওটা কেউ নিয়ে আসে। কেউ ধাক্কা খেতে খেতে ,হেরে হেরে নিজেই সেই ইস্পাত নিজের মধ্যে জন্ম দিয়ে ফেলে। অভিমন্যুর নক আউট ম্যাচগুলোতে গত কয়েক বছর হতশ্রী পারফরমেন্স। মরণ বাঁচন সময় তিনি ফের দলের ব্যাটিংয়ের নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হলেন। 

অন্য ওপেনার সুমন্ত গুপ্তর হালও একই রকম। প্রথম ইনিংসের মতো এবারও তিনি কেঁপে গেলেন। আসলে তাঁর তো কেঁপে যাওয়ার কথাই ছিল। কারণ যে ছেলেটা ক্লাবের হয়ে চার-পাঁচ নম্বরে ব্যাট করেন, তাঁকে দিয়ে এমন চাপের ম্যাচে ওপেন করালে ভালো ফলের আশা না করাই ভালো। গোটা মরসুম ধরে ফর্মের তুঙ্গে ছিলেন সুদীপ ঘরামি। ফাইনালে তাঁর সঙ্গী হল জোড়া ব্যর্থতা। ফলে চোখের নিমেষে ৪৭ রানে ৩ হয়ে যায় বাংলা। 

ঠিক এমন অবস্থা থেকে ফের লড়াই শুরু করলেন মনোজ ও অনুষ্টুপ। চাপে চুপসে না গিয়ে পালটা মার দিতে লাগলেন। কিন্তু বিকেল ৩:২৫ মিনিটে নেমে এল মহা বিপর্যয়। প্রথম ইনিংসে মনোজকে ঠিক যেমন বাইরে যাওয়া বলে উনাদকাট তাঁকে ফিরিয়েছিলেন, এবার ঠিক তেমন বলেই আউট হলেন রুকু। থামলেন ৬১ রানে। 

আর তাই জেতার আশা অনেকটা কমেছে। তবুও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন মনোজ ও শাহবাজ আহমেদ। বঙ্গ অধিনায়ক ৫৭ ও শাহবাজ ১৩ রানে টিকে থেকে এখন ফিরে আসার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল সব স্বপ্ন কি সত্যি হয়। কারণ স্কোরবোর্ড বলছে বাংলা ১৬৯ রানে ৪ উইকেট। সৌরাষ্ট্র এগিয়ে ৬১ রানে। চতুর্থ দিনের প্রথম সেশন কাটাতে পারলে হয়তো আশার আলো জ্বলে উঠতে পারে। সেটা না হলে, আরও একরাশ কটাক্ষ ও শ্লেষ ‘উপহার’ দিয়ে জয়দেব উনাদকাটদের রঞ্জি ট্রফি হাতে তোলা শুধু সময়ের অপেক্ষা। 

(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)