শিক্ষক সংকটে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষা শিক্ষা

দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষা শেখানোর উদ্যোগটি প্রশংসনীয় হলেও ফলপ্রসূ হয়নি। দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ১৮টি ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম চালুর পরিকল্পনা নিয়ে কোনও অগ্রগতি নেই। প্রথম পর্যায়ে ২০১৭ সালে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাদরি এবং গারো ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়। তবে প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় তা চরম সংকটে পড়েছে। নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে না, যারা পড়াচ্ছেন তাদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে না।

তবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিষয়গুলো নিয়ে আজও (২০ ফেব্রুয়ারি) আলোচনা হয়েছে।  প্রধানত, কারিকুলাম ডেভেলপ করার দায়িত্ব জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি)।  তারপর আমরা অর্থ ব্যয় করে এই কাজগুলো করি। এনসিটিবি কাজ অলরেডি শুরু করেছে। পাঁচটি ভাষা দিয়ে শুরু হয়েছে, আমরা পর্যায়ক্রমে বাড়াবো।  যেসব শিক্ষক আছেন তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে তৈরি করে দেওয়ার আয়োজন করবে এনসিটিবি। তারপর সেই মাস্টার ট্রেইনারদের মাঠে পাঠিয়ে দেবো। এটিরও কাজ চলছে।‘

নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে কেন জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, ‘তিন পার্বত্য জেলায় শিক্ষক নিয়োগ দেবে পার্বত্য জেলা পরিষদ। ওনারা বলেছেন, যে, ওনারা কাজ করছেন।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পাঁচটি ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়।  সেই থেকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুরা প্রতি বছর তাদের মাতৃভাষার নতুন পাঠ্যবই পাচ্ছে। তবে প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা ঠিকঠাক হচ্ছে না।  ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের ভাষা শিক্ষার জন্য নতুন করে শিক্ষক নিয়োগও দেওয়া হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘মাতৃভাষার বই পাচ্ছে এটিই এখন বড় কথা হয়ে গেছে। পাঁচটি ভাষা সংরক্ষণ হচ্ছে এই যা সান্ত্বনা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘ক্ষৃদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের ভাষা শেখার দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য কারিকুলাম প্রস্তুত রয়েছে। মন্ত্রণালয়, এমএলই ফোরাম, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর এবং এনসিটিবি বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

সূত্রমতে, বাংলাদেশে মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা (এমএলই) নিয়ে কর্মরত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অংশগ্রহণে গণসাক্ষরতা অভিযানের উদ্যোগে গঠিত হয় এমএলই ফোরাম। এই ফোরাম প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর ও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এমএলই বাস্তবায়নের বিষয়ে একটি সুপারিশমালা তৈরি করে। সুপারিশ অনুযায়ী, অগ্রাধিকারভিত্তিতে ৫/৬টি নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা নির্বাচন করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায় এমএলই ফোরাম।

এমএলই ফোরামের সদস্য সচিব তপন কুমার দাস বলেন, ‘২০১৭ সালে শুরু হয়েছিল পাঁচটি ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম। কিন্তু শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ না দিলে এটা কীভাবে সম্ভব? সরেজমিন খোঁজ নেন। শিক্ষকরা কী পড়াচ্ছেন? তাছাড়া দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের কাজ শুরুই হয়নি।’

বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের জন্য মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার জন্য প্রথমে চাকমা, সাঁওতাল, সাদরি (ওরাওঁ ও অন্যান্য), মারমা, ত্রিপুরা এবং গারো এই ৬টি ভাষায় সুপারিশ করা হয়।  দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য সুপারিশে ছিল— ম্রো, মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া, মণিপুরী মৈতেই, তঞ্চঙ্গা, খাসিয়া এবং বম।  এছাড়া তৃতীয় পর্যায়ে জন্য কোচ, কুড়ুক (ওরাওঁ), হাজং, রাখাইন, খুমি, খিয়াং/খ্যাং।

এই ১৮টি ভাষার মধ্যে পাঁচটি ভাষার শিক্ষা কার্যক্রম চালুর পর ২০২০ সালের দিকে দ্বিতীয় পর্যায়ের ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার কথা ছিল। তবে করোনার কারণে তা পিছিয়ে পড়ে। করোনা শেষ হলেও এ বিষয়ে কার্যক্রম শুরু হয়নি।

শ্রেণিভিত্তিক শিক্ষাক্রম নিয়েও সুপারিশ করা হয়েছিল। এতে বলা হয়েছিলো— প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ উপকরণ মাতৃভাষায় প্রণীত হবে। সেই সঙ্গে শ্রেণিকক্ষের শিখন-শেখানো নির্দেশনা সংশ্লিষ্ট জাতিসত্তার মাতৃভাষায় পরিচালিত হবে। এই পর্যায়ে শিশুরা প্রাক-পঠন, প্রাক-লিখন এবং প্রাক-গণিত চর্চা শুরু করবে। মাতৃভাষায় শিশুরা গল্প শুনবে, বলতে চেষ্টা করবে ও ছোট ছোট প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে। প্রাক-গণিত অনুশীলনের সময় শিশুরা প্রতিবেশ ও সংস্কৃতি থেকে নেওয়া বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করবে এবং নিজ নিজ সমাজে প্রচলিত গাণিতিক ধারণা সম্পর্কে অবহিত হবে।

প্রথম শ্রেণির মাতৃভাষা শিক্ষার বিষয়ে সুপারিশ ছিল— প্রথম শ্রেণিতে পঠন-পাঠনের সময় মাতৃভাষায় নির্দেশনা দিতে হবে। শিক্ষার্থীর ভাষা শিক্ষার চারটি দিক অর্থাৎ শুনে বুঝতে পারবে, বলে বোঝাতে পারবে, পড়তে ও লিখতে পারবে এবং পর্যায়ক্রমে শিশুর শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধি পাবে। এ জন্য মাতৃভাষায় প্রাইমার ও পরিপূরক পঠন উপকরণ রচনা করতে হবে। পরিপূরক উপকরণে মাতৃভাষায় সংশ্লিষ্ট জাতিসত্তার প্রচুর গল্প, ছড়া, গাথা সংযোজন করা যেতে পারে। শিশুর পঠনের ও সৃজনশীল লেখার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। একইভাবে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালানার জন্য নির্দেশামূলক সুপারিশ করা হয়েছিলে। কিন্তু শিক্ষক সংকটের কারণে সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি বিগত বছরগুলোতে।