মামলা-জরিমানা করেও দমানো যাচ্ছে না বন্যপ্রাণী পাচার

বাংলাদেশে পাচারের ক্ষেত্রে সব ধরনের বন্যপ্রাণী থাকে টার্গেটে। বন্যপ্রাণী উদ্ধার অভিযান প্রক্রিয়ার সঙ্গে মামলা জরিমানাও করে বন বিভাগ। কিন্তু কোনোভাবে বন্যপ্রাণী পাচার সিন্ডিকেটকে দমানো যাচ্ছে না। তবে শুধু বুঝে নয়, সচেতনতার অভাবেও এসব অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে বলে মনে করছেন বন বিভাগ সংশ্লিষ্টরা।ইউএস ‘এলিমিনেট, নিউট্রালাইজ অ্যান্ড ডিসরাপ্ট ওয়াইল্ড লাইফ’ ট্রাফিকিং প্রতিবেদনে বিশ্বের ২৮ দেশের তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে। অনেকেই বলছেন, বন্যপ্রাণী পাচারের অন্যতম রুট হিসেবে বাংলাদেশকে বিবেচনা করা হয়। দেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে বিলুপ্ত বন্যপ্রাণী ধরে যেমন পাচার করে একটি চক্র আবার অন্যদেশ থেকে আনা বন্যপ্রাণীও বাংলাদেশ হয়ে পাচার হয়। গত জুন থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বন্যপ্রাণী উদ্ধার অভিযানের চিত্র বলছে সবচেয়ে বেশি পাচার হয়েছে পাখি।

এমনই এক পরিস্থিতিতে আজ (৩ মাচ) পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস। জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলো এ দিবসটি পালন করে থাকে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হয়।

২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ৬৮তম সাধারণ অধিবেশনে ৩ মার্চকে বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০১৪ সালে প্রথম দিবসটি পালন করা হয়। বিশ্বের বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদকূলের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি করা এই দিবসের মূল লক্ষ্য।

এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘সকলের অংশগ্রহণ বন্যপ্রাণী হবে সংরক্ষণ’।

বন বিভাগের গত জুন থেকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত বন্যপ্রাণী উদ্ধার অভিযানের চিত্র:-

জুন-২২

৬৩ অভিযানে ৩৩৪টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার হয়। এরমধ্যে পাখি ২৮৭টি, মেছো বিড়াল, বানর, কচ্ছপ ও শিয়াল ৫টি করে। হনুমান, বেজি এবং গুইসাপ একটি করে, সাপ ২০টি এছাড়া ২টি করে গন্ধগোকুল ও তক্ষক উদ্ধার করা হয়।

জুলাই-২২

৪১ অভিযানে ৩১৪টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার হয়। এরমধ্যে পাখি ১৩১টি, সবুজ ব্যাঙ ১৫০টি, মেছো বিড়াল ২টি, বনবিড়াল ৭টি, মায়া হরিণ ২টি, গুইসাপ ৫টি, গন্ধগকুল ৬টি, বানর ২টি, সাপ ৮টি।

আগস্ট-২২

৫২ অভিযানে ৩২১ টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার হয়। এরমধ্যে পাখি ২৬৮টি , বনবিড়াল ৫ টি, শিয়াল-৫টি, কড়িকাইট্টা-১৬টি, কাঠবিড়ালি-২টি, গন্ধগকুল ১টি, তক্ষক ১০টি, সাপ ৮টি, বানর ৪টি, হনুমান-২টি।

সেপ্টেম্বর-২২

মোট অভিযান চলে ৫৩টি।এতে ৫৭৪টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার করা হয়। যারমধ্যে বনবিড়াল ৩টি, শিয়াল-২টি, কাঁঠ বিড়ালি ১টি, বেজি ২টি, গন্ধগকুল ৩টি, মেছো বিড়াল ২টি, সুন্ধিকাছিম ১টি, পাখি ৫২৯টি, তক্ষক ২টি, সাপ ২১টি, বানর ৪টি, হনুমান ১টি এবং গুইসাপ ৩টি।

অক্টোবর-২২

অক্টোবর মাসে ৪৮ অভিযানে ৭৯৬টি বণ্যপ্রাণী উদ্ধার হয়। এগুলোর মধ্যে শিয়াল ২টি, কড়িকাইট্টা ৩০টি, মেছো বিড়াল ২টি, সুন্ধিকাছিম ১টি, পাখি ৭৩৩টি, সাপ ১৯টি, বানর ৭টি, গুইসাপ ২টি।

নভেম্বর-২২

গত নভেম্বরে ৫০৪টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার করা হয়েছে। এজন্য সারাদেশে ৫১টি অভিযান চালানো হয়। উদ্ধারকৃত বন্যপ্রাণীর মধ্যে ৩৪৩টি বিভিন্ন প্রজাতির পাখি রয়েছে। এছাড়া সাপ ১৪টি, বানর ৬টি, বাঘাআইড় মাছ ১টি, হনুমান-২টি, লোনা পানির কুমির ১টি, কাড়িকাইট্টা ৮০টি, বনবিড়াল-১টি, সুন্ধিকাছিম ৫৫টি, বেজি একটি।

ডিসেম্বর-২২

গত ডিসেম্বরে ৩৬টি অভিযানে ২৭৪টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার হয়। এরমধ্যে সুন্ধি কচ্ছপ ১৪টি, শিয়াল-১টি, বনবিড়াল ২টি, গন্ধগকুল ২টি, বেজি ১টি, পাখি ২৪১টি, সাপ ৬টি, বানর ৬টি, হনুমান-১টি

জানুয়ারি-২০২৩

৩৬ অভিযানে ৩১৫টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার হয়। এরমধ্যে সজারু-১টি, শিয়াল-২টি, বনবিড়াল ৯টি, গন্ধগকুল ১টি, ভালুক শাবক ২টি, পাখি ২৮০টি, সাপ ৩টি, বানর ১২টি, গ্রিভেট বানর ৪টি এবং গুইসাপ ১টি।

সবচেয়ে বেশি পাচার হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি

বন্যপ্রাণী উদ্ধার অভিযানে প্রাণী উদ্ধারের পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতেও কাজ করছে বন অধিদফতরের একটি ইউনিট।  গত জুনে দেখা যায়, এই ইউনিট ১৫টি বন্যপ্রাণী বিষয়ক অনলাইন সভা করেছে। সচেতনতামূলক লিফলেট, পোস্টার, বুকলেট এবং স্টিকার বিতরণ করেছে ২ হাজার ৪০০টি। পাশাপাশি বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন- ২০১২ বিষয়ে সচেতন করা হয় ২৪০০ জনকে, বন্যপ্রাণী অপরাধ এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ২টি, ১ আসামির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়, ২টি মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ৪ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও জরিমানা করা হয়। তক্ষক পাচারের দায়ে ১১ আসামির বিরুদ্ধে থানায় ২টি মামলা দায়ের করা হয়। শুধু জুনে নয় প্রতিমাসেই এ ধরনের তৎপরতা চালায় ইউনিট।সূত্র বলছে, বন্যপ্রাণী ধরা, মারা, খাওয়া, ক্রয়-বিক্রয়, পাচার, দখলে রাখা বা শিকার করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

বন্যপ্রাণী অপরাধ সংক্রান্ত যেকোনও তথ্য জানাতে হটলাইন নাম্বারে ফোন করলে তাদের নাম পরিচয়ও গোপন রাখা হবে বলে বন অধিদফতরের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। অথবা ইমেইল [email protected]।

নাম্বারগুলো হচ্ছে-

+8801999000095

+8801713076683

+8801916095643

+8801747036237

+8801611786536

এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের (বনবিভাগ) পরিচালক মো. সানাউল্লাহ পাটোয়ারী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বন্যপ্রাণী পাচার করা যে অপরাধ তাও অনেকে জানে না। অনেকে অভাবের কারণে, অনেকে কাজের জন্য, অনেকে আবার শখ করেও এই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আমরা তাই শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পাশাপাশি সচেতনতার ওপর জোর দিচ্ছি। বিষয়টি একদিন বা দুইদিনে সমাধান সম্ভব নয়। আবার একেবারে নির্মূল করা যাবে কিনা তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ বনের কাছাকাছি বসবাসকারীরা বিপদে পড়লে এসবে আবার জড়িয়ে পড়তেই পারে।

তিনি বলেন, আমরা আগের চেয়ে অনেক কঠোর অবস্থানে গিয়েছি। নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। আশা করছি এই অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে। প্রাণীরা বনে নিরাপদে থাকতে পারবে।

মামলা-জরিমানা করেও দমানো যাচ্ছে না বন্যপ্রাণী পাচার

দিবসটি ছুটির দিন শুক্রবার পড়ায় এ উপলক্ষে আগামী ৫ মার্চ (রবিবার) অফিসের খোলা দিনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়েরর উদ্যোগে ঢাকার আগারগাঁওয়ের বন ভবনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে বলে জানায় পরিবেশ মন্ত্রণালয়। এতে প্রধান অতিথি হিসাবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের উপস্থিত থাকবেন।