History of Kolkata: ভাঙা হবে বাড়ি, জেনেও দেওয়ালে শহরের ইতিহাস আঁকেন বরাহনগরের প্রীতম

‘এখানে প্রীতমের বাড়িটা কোথায়? প্রীতম, ছবি আঁকেন যিনি।’

প্রশ্ন শুনে কিছুটা মূর্তির মতোই স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে থাকেন মাঝবয়সি মানুষটি। টেরিকটনের প্যান্ট, গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। দু’হাতে ভর্তি তেলকালি। পিছন থেকে ভেসে আসে মেশিনের আওয়াজ। বোঝা যায়, গ্রিলের গেটের শব্দ শুনে কাজের মধ্যেই ছুটে এসেছেন। কিন্তু কে যে প্রীতম, তা বহু ক্ষণ বুঝে উঠতে পারছেন না। অথচ এটাই প্রীতমদের বাড়ি। অন্তত ঠিকানা যদি সঠিক হয় তো!

ঠিক তখনই সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসেন এক যুবক। নীল টিশার্ট, ছাই রঙের ঢিলা প্যান্ট। বয়স পঁচিশ থেকে তিরিশের মধ্যে। ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিই প্রীতম।’ মুহূর্তে বদলে যায় মাঝবয়সির মুখচোখে। ভাবখানা এমন, ‘ওহ! এ-ই প্রীতম! এ তো আমাদের ছোট্টু, বা গোপাল, বা বাপন! এ আবার ছবি আঁকে কবে? এ তো দেওয়ালে ছাইভস্ম কীসব আঁকিবুকি কাটে।’ অমন ভাব নিয়েই মাঝবয়সি ফিরে যান মেশিনের ঘরে। আর প্রীতম-সহ আমাদের গন্তব্য হয় দোতলা এবং তেতলার দিকে।

বরাহনগরের প্রীতম দাস। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ। তবে আর পাঁচ জনের মতো করে নিজের ছবি নিয়ে প্রচারের আলোয় আসেননি এবং আসতে চাননি প্রীতম। পেশার তাগিদে উত্তরবঙ্গের এক মহাবিদ্যালয়ে আঁকাশেখানোর চাকরিতে নিযুক্ত তিনি। অথচ তাঁর অতি নিকটের প্রতিবেশীও বোধকরি জানেন না, প্রীতম ঠিক কোন কাজটি করেন।

বাঙালি ঘরের যুবক। এখন যাঁরা যৌবনে পায়চারি করছেন, তাঁদের অধিকাংশকেই ছোটবেলায় পড়াশোনার পাশাপাশি আরও কিছু শেখানোর চেষ্টা হয়েছে। সাম্ভব্য যা যা শেখানো যেতে পারে, অদৃশ্য কাগজের টুকরোয় সে সবের নাম লিখে ফেলে দেওয়া হত তাদের সামনে। এবং অবধারিতভাবেই তাদের হয়ে অদৃশ্য চিরকুটের মধ্যে থেকে একটি বেছে নিতেন তাদের অভিভাবকেরাই। এবং সেই তালিকায় সর্বাগ্রে যা আসত, তা হল আঁকা। স্কুলে পড়বে আর ফি-রোববার আঁকার ক্লাসে যাবে।

যে ঘরে এক সময়ে ছিল খাট, এখন তার দেওয়ালে খাটের ছবি শুধু। 

প্রীতমের জীবনেও এর বিশেষ ব্যতিক্রম ঘটেনি। পেনসিলে আপেল, জলের কল, হাতের তালু আঁকা শেখার পরে একে একে জল রং, তেল রঙের পাঠ নিয়েছেন তিনিও। চর্চাও করেছেন। কিন্তু আমফান বদলে দিয়েছে তাঁর দেখার চোখ।

বরাহনগরের প্রীতম। উত্তরোস্য উত্তর কলকাতার অলি-গলির অন্ধি-সন্ধিতে পাক খেতে খেতে পৌঁছোতে হয় তাঁদের বাড়ি। শত বছরের কাছাকাছি বয়স হতে যাওয়া বাড়ি। এই বাড়ি সাক্ষী বহু প্রজন্মের জন্মের, বহু প্রজন্মের প্রয়ানের, বহু বিয়ের, বহু ভাঙনের। এক কথায় মধ্যবিত্ত এক বাঙালি পরিবারের ইতিহাসের। আর কে না জানেন, প্রকৃতি ইতিহাস পছন্দ করে না, ইতিহাসের সাক্ষীদের পছন্দ করে না। সুযোগ পেলেই প্রকৃতি গ্রাস করতে চায় তাদের। বহু কিছুর সাক্ষী এই বাড়ির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আমফান গ্রাস করেছে তাকে। জায়গায় জায়গায় ধরেছে ফাটল, ভেঙেছে তেতলার ছাদ, খসেছে পলেস্তরা। বাড়িছাড়া হতে হয়েছে প্রীতমদের। বহু ভাঙনের শেষ ভাঙন এবার প্রত্যক্ষ করবে এই বাড়ি। নিজের ভাঙন।

কিন্তু তার আগেই প্রীতম বেছে নিয়েছেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ক্যানভাস। তাঁর ভগ্নপ্রায় বাড়ির দেওয়াল। সেই দেওয়ালেই তিনি আঁকতে শুরু করেছেন, তাঁর পাড়া, তাঁর পথঘাট, তাঁর ব্যক্তি জীবনের স্মৃতি।

‘আমফানের পরে আমরা সবাই বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। যে বাড়িটা আমাদের পরিবারের, আমাদের পাড়ার এত কিছুর সাক্ষী, তার যেন মৃত্যু হয়। তখনই একদিন আমার মনে হয়, যা ভেঙে পড়বেই, সেখানে যদি অন্য কোনও কারণে আমি আবার ফিরে যাই…’

প্রীতম তাই একাই ফিরে আসেন এই বাড়ির কাছে। মৃতপ্রায় স্বজনের কাছে শেষ বারের মতো মানুষ যেভাবে ফিরে আসে, সেভাবেই একা এ বাড়ির দোতলায় ফেরেন তিনি। শুরু হয় দেওয়াল জুড়ে ‘মানচিত্র’ আঁকা। এ মানচিত্র, সে মানচিত্র নয়। প্রীতমের ভাষায়, এ হল ‘রিভার্স পার্সপেকটিভ’-এ আঁকা ছবি। বরাহনগরের রাস্তাঘাট যেখানে উঠে আসে দোতলা আর তেতলার মাঝের সিঁড়িতে। যেখানে এক সময়ে রাখা ছিল তিন ফুট বাই দেড় ফুটের অ্যাকোয়ারিয়াম, দেওয়ালে গেঁথে ছিল সুইচবোর্ড, ঠিক সে সব জায়গাতেই ফিরতে শুরু করে তারা। তবে ছবি হয়ে। পলেস্তরা খসা দেওয়ালে কালো রঙে আঁকা, মনখারাপ করা ছবি।

<p>দেওয়ালে প্রীতমের আঁকা ছবি। </p>

দেওয়ালে প্রীতমের আঁকা ছবি। 

বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস হবে তাঁর নিজের সব কাজও। একথা বলতে বলতে হেসে ওঠেন প্রীতম। সরল শিশুর মতো হাসি। কাজ ধ্বংস হয়, স্মৃতি হয় না। ‘আমি কি ভুলেছি সব স্মৃতি… মোষের ঘাড়ের মতো পরিশ্রমী মানুষের পাশে শিউলি ফুলের মতো বালিকার হাসি’ নিয়ে প্রীতম সলজ্জভাবে বলেন, ‘যখন এই কাজটা শুরু করেছিলাম, তার আগে থেকেই জানতাম, এই বাড়িটা একদিন ভাঙা হবে। তার মানে, দেওয়ালে আঁকা আমার কাজগুলোও ভাঙা হবে। সেটা ভেবেই আঁকতে শুরু করেছিলাম।’

প্রীতম কি ফ্রানসিসকো গোয়ার নাম জানেন? নিশ্চয়ই জানেন। তাহলে একথাও জানেন, জীবন উপান্তে পৌঁছে গোয়া তখন সম্পূর্ণ বধির এবং প্রায় অন্ধ। এমন সময়ে মাদ্রিদ শহরে নিজের বাড়ির দেওয়াল জুড়ে গোয়া আঁকতে শুরু করেন ‘ব্ল্যাক পেইন্টিং’ সিরিজ। চিত্রশিল্পের ইতিহাসে যা এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে ‘ভয়ঙ্কর’ ছবির সিরিজের একটি। মাদ্রিদের সেই ‘কুইন্তা দেল সোর্দো’ বা বধির মানুষের বাগানবাড়ি এখন এক জাদুঘর। কথিত আছে, প্রায় অন্ধ শিল্পী নিজের টুপিতে মোমবাতি বসিয়ে দেওয়ালের উপর মাথা ঝুঁকিয়ে দিয়ে এঁকে যেতেন একের পর এক ছবি। কেন আঁকতেন? অবান্তর স্মৃতির মাঝে কোনও মুখের সন্ধানের জন্য নয়, বিশ্ব চরাচরে প্রভাব ফেলার জন্য নয়, ভবিষ্যতের কাছে জবাবদিহির জন্য নয়— এমনি আঁকতেন। যে আঁকা দেখে ঘুম উড়েছে পরের সব প্রজন্মের। বলাই বাহুল্য প্রীতম ভয় দেখানোর সে সুযোগ পাবেন না।

বরাহনগরের প্রীতম দাসের বাড়ির দোতলা আর তেতলায় বিদ্যুতের কানেকশন আর নেই। একতলায় জিইয়ে রাখা হয়েছে। কারণ সেখানে এখনও কোনও ক্রমে চালু আছে লেদের কারখানা। দু’দিন বাদে সেটিও আর থাকবে না। তাই নীচের মিটারবক্স থেকে তার টেনে পঞ্চাশ ওয়াটের বাল্ব জ্বালিয়ে দেওয়াল জুড়ে ছবি আঁকেন প্রীতম। রাত ঘনিয়ে এলে অন্ধকার বাড়ে। দেওয়ালের উপর মাথা ঝুঁকিয়ে দিয়ে ছবি আঁকেন প্রীতম।

‘আঁকেন আলপনা, আঁকেন লতা লতাপাতা, আঁকেন মহেন্দ্র দত্তর ছাতা’। চকিতে মনে পড়ে ওই কোণে পড়ে ছিল মশা মারার কয়েল। নারকেল মালায় কালো রং গুলে তুলি দিয়ে এঁকে দেন মেঝের বুকে। বছর বিশ আগে ফ্যানের হাওয়ায় দেওয়ালে কেঁপে ওঠে ক্যালেন্ডার। তার ঘষায় থেকে যাওয়া অর্ধবৃত্তাকার দাগের উপর স্মৃতির মানচিত্রের ট্রেসিং পেপার ফেলে এঁকে দেন পদ্মাসনা সারদামণি। তাঁর বুকে অচিরেই পড়বে ছেনি-হাতুড়ি, বাড়বে ফাটল জেনেও আঁকেন প্রীতম।

<p>শেষ চিহ্ন</p>

শেষ চিহ্ন

ছবি আঁকার অজুহাতে ইতিহাস আঁকেন প্রীতম। নিজের ইতিহাস, স্থানীয় ইতিহাস, শহরের ইতিহাস। এক কবি লিখেছিলেন, ‘অজুহাত মিথ্যা প্রমাণিত হলে, গরাদের জ্যাতিমিবিধুর ছায়া আমার শরীরে পড়ে আমাকেও ক্লাসিক দেখাবে, আমি জানি।’ বোধহয় প্রীতমও জানেন। তাই এঁকে চলেন তিনি। এঁকে চলেন কলকাতার গোয়া।

(এই খবরটি আপনি পড়তে পারেন HT App থেকেও। এবার HT App বাংলায়। HT App ডাউনলোড করার লিঙ্ক https://htipad.onelink.me/277p/p7me4aup)