যেসব বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় সরকার

সাধারণত আগের অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের সূচক ধরেই পরবর্তী বছরের বাজেট প্রস্তুত করা হয়। ফলে চলতি অর্থবছরের ৯ মাস শেষ হতেই অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেট তৈরির মূল প্রস্তুতি নিচ্ছে। আগামী জুন মাসের প্রথমার্ধে নতুন বাজেট দেওয়া হবে।

জানা গেছে, ২০২৩-২৪ নতুন অর্থবছরের জন্য সাড়ে ৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে জাতীয় বাজেট। যদিও বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে, আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে যথাক্রমে ৫ দশমিক ২ ও ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। নতুন অর্থবছর মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য রাখা হতে পারে ৬ শতাংশ।

তবে নতুন অর্থবছরের বাজেটে সার্বিক ভর্তুকির পরিমাণ বাড়বে। বাজেট তৈরিতে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে সরকারের দুশ্চিন্তা বাড়বে। ডলারের দর এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়েও সরকারকে দুশ্চিন্তায় ফেলবে। এসব নিয়ে অনেকটাই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

কত বড় হবে বাজেট

সূত্র জানায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার হতে পারে ৭ লাখ কোটি টাকার বেশি। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা, যা সংশোধন করে হতে পারে ৬ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা। নতুন অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) হতে পারে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা।  বাজেট ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হতে পারে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব ব্যয়ের মধ্যে সুদ ব্যয় থাকবে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য রাখা হতে পারে ৬ শতাংশ।

উল্লেখ্য, সরকারের ফিসক্যাল কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের সভায় সামষ্টিক অর্থনীতির নীতি, বাজেটের মূল দর্শন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতিএসব ঠিক করা হয়। পরে সম্পদ কমিটির সভায় সেই আলোকে বরাদ্দ চূড়ান্ত করা হয়।

সতর্কতা কী কী

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, নতুন অর্থবছর দেশের বাজেটে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়বে। সরকার চাইলেও আগামী বাজেটে ভর্তুকি খুব বেশি কমাতে পারবে না। কারণ চাপে থাকা অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার করতে হবে। সে ক্ষেত্রে কয়েকটি খাতে চাইলেও ভর্তুকি কমানো যাবে না। নির্বাচনের বছর হিসেবেও এ বিষয়ে সরকারকে চতুর দৃষ্টি রাখতে হবে।

বাজেট সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাজেটের জন্য সরকারকে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। আর সেগুলো হচ্ছে- আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ করতে হবে। রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বাজেট ঘাটতি সীমার মধ্যে রাখতে হবে এবং বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট তৈরি কাজে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকারের পক্ষ থেকে ডলার-সংকট মোকাবিলা করে রিজার্ভ ধরে রাখতে গত বাজেটের আগে এবং বাজেটে গাড়ি, ফলমূল, প্রসাধনসামগ্রীসহ বিভিন্ন ধরনের বিলাসপণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্ক-কর বৃদ্ধি এবং এলসি মার্জিন বাড়িয়ে দেওয়া হয়। তাতেও সংকট কাটেনি। নতুন বছরের জন্য বাজেট তৈরির কাজকে জটিল করেছে এই ডলার সংকট।

গত বছরের এপ্রিল থেকেই ডলারের দাম বাড়তে থাকে। তখন প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা, যা এখন গড়ে ১০৫ টাকার বেশি। একই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারের পণ্যের দাম ছিল বেশি। ফলে বেশি দামে ডলার কিনে আমদানি করতে গিয়ে রিজার্ভ কমে যায়। যে রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের, তা এখন ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলারের আশে পাশে অবস্থান করছে।

জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমানোর শর্ত দিয়েছে। কিন্তু এর পরেও চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরের জন্য প্রায় ৩৫ শতাংশ বেশি পরিমাণের ভর্তুকির প্রস্তাব করা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি প্রস্তাব করা হয়েছে এক লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকির পরিমাণ ৮১ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।

আসন্ন বাজেটে ভর্তুকির পাশাপাশি সরকারের নেওয়া ঋণের সুদের পরিমাণও বাড়বে। আগামী বছরের জন্য ঋণের সুদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে ২৭ শতাংশ, টাকার অঙ্কে যা প্রায় এক লাখ কোটির বেশি। চলতি অর্থবছরে সরকারের নেওয়া ঋণের বিপরীতে সুদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৭৯ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ঋণের সুদের পরিমাণ বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ।

বাজেট সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, প্রতিবছরই সরকারের স্থির করা লক্ষ্যে রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। এর ওপর রয়েছে বাড়তি মূল্যস্ফীতি, ডলার-সংকটসহ নানা চাপ। এর মধ্যেও সরকারকে নতুন বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। আবার আইএমএফের শর্ত মেনে রাজস্ব ও আর্থিক খাতের সংস্কারও করতে হবে। অন্যদিকে এবার মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি থাকায় গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষকে আরও বেশি সুরক্ষার আওতায় আনতে হবে। সে জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

শহরের গরিবদের জন্য কোনও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি না থাকলেও ১২২টির বেশি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে যার সবই গরিব মানুষের জন্য নয়। যেমন সরকারি কর্মচারীদের পেনশনের টাকাও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বরাদ্দ দেওয়া হয়।

রয়েছে সুখবরও

আগামী অর্থবছরের জন্য ভালো দিকও রযেছে। সেসব ভালো দিক হচ্ছে- প্রবাসী আয় ও রফতানি আয় এখনও ভালো অবস্থানে আছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ১ হাজার ৪০১ কোটি ডলারের বেশি প্রবাসী আয় এসেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৮ কোটি ডলার বেশি। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৯ শতাংশের মতো।

এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, আমরা চেষ্টা করছি। তবে যতো ব্যালেঞ্জই হোক না কেনও সরকারের বাজেট হবে জনবান্ধব। এ নিয়ে কোনও সংশয় থাকা উচিত নয়। শেখ হাসিনার সরকার মানবদরদি সরকার বলেও জানান তিনি।